ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

করোনায় বাড়ছে বাল্যবিয়ে

প্রকাশনার সময়: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:৪৩

কুড়িগ্রাম জেলার চর সারডোব। ধরলা নদীর কারণে বিচ্ছিন্ন এ চরটি। সারডোব আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। চরের আলোচিত এ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির ছাত্রী নার্গিস নাহার। তারা ৯ বান্ধবী একসঙ্গে অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। কিন্তু করোনা মহামারিতে লকডাউনের সময় ৮ বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে। এখন ক্লাসে কেবল নার্গিস নাহারই একা মেয়ে। প্রত্যন্ত এ চরে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে একাই পড়া চালিয়ে লড়াই করছে সাহসী নর্গিস।

এভাবেই করোনার জেরে রংপুরের কুড়িগ্রাম ও টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ঝরে পড়েছে শিক্ষার্থী। মির্জাপুর উপজেলার তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৪০ শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। তারাও লেখাপড়া বন্ধ করে এখন স্বামীর সংসার করছে। এ অঞ্চলগুলোতে নার্গিসদের মতো কোমলমতি মেয়েরা স¦প্নের ডানা না মেলতেই বাল্যবিয়ের অভিশাপে ভেঙে পড়েছে সে ডানা।

বরাবরের মতোই এবারো করোনার দোহাই দিয়ে সারডোব চরে কন্যাশিশুদের একটা বড় অংশ শিকার হয়েছে বাল্যবিয়ের। তবে বান্ধবীদের বিয়ের কথা জানতে পেরে আতঙ্কে রয়েছে সে। কবে যেন বাবা-মা তাকেও ওদের মতো জোর করে বিয়ে দিয়ে দেন!

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত কুড়িগ্রাম জেলায় মোট বিয়ে সংগঠিত হয়েছে ২২ হাজার ৩৯১টি। এর মধ্যে নিবন্ধিত বিয়ে ১৯ হাজার ২২১টি এবং অনিবন্ধিত বিয়ে ৩ হাজার ১৭০টি। জেলার ৯টি উপজেলায় বাল্যবিয়ে সংগঠিত হয়েছে ৩ হাজার ১৯টি। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম সদর-৭৩০টি, রাজারহাট-৭৪টি, উলিপুর-২৬১টি, চিলমারী-১৪৬টি,

রৌমারী-৮৮টি, রাজিবপুর-৫০টি,

নাগেশ্বরী-১১৪০টি, ফুলবাড়ি-২৯১টি, ভূরুঙ্গামারীতে-২৩৯টি বাল্যবিয়ে সংগঠিত হয়েছে। এছাড়াও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ হয়েছে এক হাজার ১৩৬টি।

করোনাপরবর্তী স্কুল খোলায় নার্গিস নবম শ্রেণির ক্লাসে আসে। সে ছেলে সহপাঠীদের সঙ্গে একটি ব্রেঞ্চে একাই পাঠদানে অংশ নিয়েছে। এদিন তার কেটেছে মন খারাপ নিয়ে। আনন্দ মাখা মুখে সবাই যখন ক্লাস করে তখন নার্গিস নাহারের চোখে-মুখে অদৃশ্য আতংক কাজ করে। হাজারো দুশ্চিন্তায় নার্গিসের মুখে দেখা দেয় মলিনতা। কীভাবে লেখাপড়া করার স্বপ্ন পূরণ হবে? কেননা এই শ্রেণিতে ৯ ছাত্রীর মধ্যে ৮ জনেই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। করোনার দেড় বছরে বিদ্যালয়ে নার্গিস নাহার ছাড়া যেসব ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে তারাÑ নুরবানু খাতুন, নাজমা খাতুন, স্বপ্না খাতুন, হেলেনা খাতুন, চম্পা খাতুন, লুৎফা খাতুন, চাঁদনী খাতুন এবং আরফিনা খাতুন।

নার্গিস আক্ষেপ করে বলে ‘এখন শুধু আমিই বাকি রয়েছি। ক্লাসজুড়ে আমি শুধু একা। কারো সঙ্গে কোনো কিছু শেয়ার করতে পারি না। তাই মন খারাপ করেই ক্লাস করতে হচ্ছে। আমার শেষ পরিনতি কী হবে তাও অজানা। আমি আমার বাবা-মাকে অনুরোধ করেছি, আমাকে যেন হঠাৎ করে বিয়ে না দেন। আমি পড়াশোনা শেষ করে একটি চাকরি করে নিজের অবস্থা তৈরি করেই বিয়ে করব। এর আগে নয়। কেননা নিজে স্বাবলম্বী না হয়ে অন্যের কাছে বোঝা হয়ে থাকতে চাই না।

সারডোব আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলে রহমান বলেন, আমার বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ২২৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৩ ছাত্রী। এদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ মেয়ে এবং ৭০ শতাংশ ছাত্র বিদ্যালয়ে উপস্থিত হচ্ছে। প্রাথমিক তথ্য মতে, বিয়ে হয়েছে ১৮ ছাত্রীর। এর মধ্যে বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির চারজন ছাত্রীর মধ্যে জেসমিন ছাড়া বাকি তিনজনেরই বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে। নবম শ্রেণিতে ৯ জনের মধ্যে নার্গিস ছাড়া ৮ জনের বিয়ে হয়েছে, এছাড়াও ষষ্ঠ শ্রেণির একজন, সপ্তম শ্রেণির দু’জন, অষ্টম শ্রেণির চারজনের বাল্যবিয়ে পরিবার থেকে গোপনে দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়।

একই এলাকার উত্তর হলোখানা নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল রাজ্জাক বলেন, তার বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে-৪২ ছাত্রীর মধ্যে ২জন, ৭ম শ্রেণিতে-৪৫ ছাত্রীর মধ্যে ২ জন এবং ৮ম শ্রেণিতে-৩৩ ছাত্রীর মধ্যে ৫ ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে।

এদিকে সারডোব চরের বাসিন্দা বুলবুলি বেগম বলেন, ‘তাড়াতাড়ি বিয়ে দেই হামরা গরিব মানুষ। মেয়ে ছইল যত বড় হইবো তত ডিমান্ড হার বাড়বো। মেয়ে যদি মেট্রিক পাস করাই তাইলে ছেলে নেয়া লাগবো ইন্টার পাস। সেই সামর্থ্য যদি হামরা করবার না পারি সে জন্য ছোটতে মেয়ের বিয়ে দেই।’ একই এলাকার আহাম্মদ আলী বলেন, বাল্যবিয়ে তো এলাকায় হয় না। মেয়ে পক্ষ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেয় গোপনে। কেউ এক ইউনিয়ন থেকে অন্য ইউনিয়ন, আবার কেউ উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেয়। বিয়ের কথা সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ না করে পনেরো দিন, এক মাস পর প্রকাশ করে বাবা-মা।

এদিকে গত দেড় বছরের মধ্যে মির্জাপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গেড়ামাড়া গোহাইলবাড়ি সবুজ সেনা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির চারজন, ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ১৯ জন ও ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ৯ ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এদিকে, মির্জাপুর সদরের আফাজ উদ্দিন দারুল উলুম দাখিল মাদরাসায় গত দেড় বছরে অষ্টম শ্রেণির একজন ও নবম শ্রেণির চারজন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে।

একই পরিস্থিতি মির্জাপুরের ৬৬ নম্বর বহুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। এ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান চলে। গত দেড় বছরে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অষ্টম শ্রেণি পাস তিন শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা বাল্যবিয়ের খবর পেয়ে বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হয়ে কয়েকটি বিয়ে বন্ধও করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ওইসব পরিবারের

অভিভাবকরা বিভিন্ন উপায়ে বয়স বাড়িয়ে মেয়েদের বিয়ে দেন বলে অভিযোগ শিক্ষকদের।

গেড়ামাড়া গোহাইলবাড়ি সবুজ সেনা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, বাল্যবিয়ে আগামী প্রজন্মের সুস্থভাবে বেড়ে উঠা এবং

সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের এ বিষয়ে বুঝালেও তারা বুঝতে চেষ্টা করেন না। বিভিন্ন উপায়ে মেয়েদের বয়স বৃদ্ধি করে তাদের বিয়ে দেন অভিভাবকরা।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ