ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

যে কারণে ফরিদপুরে আ.লীগের ঘাঁটিতে ডুবলো নৌকা

প্রকাশনার সময়: ২৭ ডিসেম্বর ২০২১, ২০:৪৪ | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২১, ২০:৫০

‘হাবাজাবা’ প্রার্থী ও দলীয় কোন্দলে আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে নৌকার ভরাডুবির ঘটনা ঘটেছে। চতুর্থ ধাপে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ৯টিতেই আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। আর পরাজিত হওয়ার পর এ মূল্যায়নই করছেন উপজেলা ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।

পরাজিত ৯ প্রার্থীর মধ্যে জামানত হারিয়েছেন আওয়ামী লীগের ৩ প্রার্থী। তারা হলেন, চতুলে ইউপি আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খন্দকার আবুল বাশার, গুনবাহা উপজেলা কৃষক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল ইসলাম ও দাদপুরে ইউপি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাজ্জাদুর রহমান।

১০টি ইউনিয়নের মধ্যে শুধুমাত্র শেখর ইউনিয়নে জিতেছে আওয়ামী লীগ। বাকি নয়টি ইউনিয়নেও আওয়ামী লীগ ভালো করতে পারেনি। চারটি ইউনিয়ন ঘোষপুর, সাতৈর, ময়না ও রূপপাতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন দাদপুর ও বোয়ালমারীতে। গুনবাহা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কামরুল ইসলাম চার জনের মধ্যে চতুর্থ হয়ে জামানত খুইয়েছেন। চতুলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী খন্দকার মো. আবু বাশার পাঁচজনের মধ্যে চতুর্থ হয়ে জামানত খুইয়েছেন, পরমেশ্বরদীতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছয়জনের মধ্যে চতুর্থ হয়েছে।

দলের এই বিপর্যয়কর অবস্থায় একমাত্র ব্যতিক্রম শেখর ইউনিয়নের নৌকার প্রার্থী কামাল আহমেদ। তিনি এক হাজার ৮৮৭ ভোটের ব্যবধানে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. আবুল কালাম আজাদ (মোটর সাইকেল) কে হারিয়ে সম্মান বাঁচিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের।

বোয়ালমারীর ইউপি নির্বাচনে এই যখন শাসকদল আওয়ামী লীগের অবস্থা তখন স্বাভাবিক ভাবেই ফলাফল বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে এ নৌকাডুবির কারণ কি? কেন এ বিপর্য়য়কর অবস্থা আওয়ামী লীগের। চতুর্থ ধাপে ইউপি নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকে এ প্রশ্ন ফিরছে সচেতন মানুষের মুখে মুখে।

বোয়ালমারী উপজেলা ফরিদপুর-১ সংসদীয় এলাকাভুক্ত। এ অঞ্চলটি বরাবরই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ২০০৫ এর উপনির্বাচন বাদে বাকি প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে এ আসন থেকে জিতেছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী।

তৃণমূল থেকে প্রার্থীদের সুপারিশ করে জেলা আওয়ামী লীগের মাধ্যমে কেন্দ্রে পাঠিয়েছিল উপজেলা আওয়ামী লীগ। প্রতিটি ইউনিয়নের ক্ষেত্রে ছয় থেকে সাতজন করে প্রার্থী বাছাই কারে ১০টি ইউনিয়নের জন্য মোট ৬৫ জন নেতা-কর্মীর নাম সুপারিশ করে কেন্দ্রে পাঠানো হয়। মনোনয়নপত্র প্রদানের পর দেখা গেছে প্রতি ইউনিয়নের তালিকার এক, দুই নম্বর বাদ দিয়ে তিন কিংবা চার নম্বর ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। মনোনয়ন ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতারা জানায় বেশির ভাগ মনোনীত প্রার্থী দুর্বল হয়ে গেছেন।

ফলে নির্বাচনে ১৬জন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী বিদ্রোহী প্রার্থী হন। শেষের দিকে বিদ্রোহী প্রার্থীদের দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও ততদিনে সময় অনেক পাড় হয়ে গেছে। এছাড়া দিনে নৌকার পক্ষে কাজ করলেও উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রথম সাড়ির অনেক নেতাকে গোপনে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা ও রসদ সরবরাহ করতে দেখা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের অন্তত সাতজন নেতা-কর্মী বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের কাঁদা ছোড়াছুড়ি কারণে হেভিওয়েট প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে বাদ পড়ায় নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। নৌকার ভরাডুবির জন্য আওয়ামী লীগের নেতারাই দায়ী। পাশাপাশি বোয়ালমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাথে কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমানের স্নায়ুযুদ্ধ থাকায় জেদাজেদির কারণে প্রার্থী বাছাই সঠিক হয়নি।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পীকুল মীরদাহ বলেন, আমরা প্রতিটি ইউনিয়নে একাধিক প্রার্থীর নাম সুপারিশ করে কেন্দ্রে পাঠালেও এলাকায় কোন প্রার্থীর কেমন অবস্থান তা জানিয়েছি। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের সে বিষয়গুলি আমলে আনা হয়নি। তিনি বলেন, প্রার্থীরা দুর্বল ছিল। অনেক প্রার্থী মনোনয়ন পাওয়ার পর মাঠে নামতে দেখা গেছে। অথচ সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রত্যাশীরা গত দুই তিন বছর ধরেই এলাকায় নিজেদের ভিত পোক্ত করে নিয়েছিলেন।

‘নির্বাচনের এ ফলাফলে লজ্জা পেয়েছি, আমার তো বাড়ি থেকে বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই। কাউকে মুখ দেখাতেও পারছি না’-মন্তব্য করে পীকুল মীরদাহ বলেন, আমাদের মতামত মত কাজ হয়নি কেন্দ্রে। হাবাজাবা প্রার্থী হইলে তো ফল হাবাজবাই হবে।

দলের প্রার্থীর হেরে যাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে ফরিদপুর-১ (বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা, মধুখালী) আসনের সাবেক সাংসদ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, বাস্তবতা হলো নৌকার প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ সম্মিলিত ভাবে কাজ করেনি। আভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলাদলি ও নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ কাজ করেছে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের। পাশাপাশি এলাকার রাজনৈতিক মেরুকরণ ও গোষ্ঠিস্বার্থ এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, দল ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করলে প্রার্থীদের হারার প্রশ্নই উঠতো না।

‘প্রার্থী হাবাজাবা হয়েছে’-এ অভিযোগের বিষয়ে আব্দুর রহমান বলেন, তৃণমূল থেকে যে সুপারিশ করা হয়েছে তাদের ভিতর থেকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। প্রার্থী ভালো হয়নি-এটা একটা অজুহাত।

আব্দুর রহমানের বক্তব্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে পীকুল মীরদাহ বলেন, আমরা প্রার্থীর সম্পর্কে মতামত দিয়েছিলাম। বলছি ওমুককে দিলে জিতবে, ‘অমুককে দিলে জিতবে না’। তা আমলে নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি স্থানীয় আধিপত্য, রাজনীতির মেরুকরণ এবং গোষ্টিগত সার্থ কাজ করছে। মাঠের পরিচিত প্রার্থীরা মনোনয়ন পায়নি। ‘দেখি একটা মনোনয়ন কিনে কি হয়’-এ জাতীয় ভাবনার ৮০ ভাগকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়।

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ