ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

যেমন ছিল সাহাবায়ে কেরামের রমজান

প্রকাশনার সময়: ১৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৪, ১৯:৪৬

মাহে রমজান অতিবাহিতকারী তিন দলে বিভক্ত। একজন হলেন এমন যার জন্য এ মাস এবং বছরের অন্যান্য মাসে কোনো তফাৎ হয় না। সে হলো অকৃতকার্য হতভাগা লোক।

দ্বিতীয়জন হলেন আবেদ শ্রেণির। শুধু ইবাদত করেন। তার রমজানের সওয়াব তো হয়, কিন্তু রমজান মাস চলে যেতেই তার ইবাদতের আগ্রহ-উদ্দীপনা সব শেষ হয়ে যায়। তিনি আবার পূর্বেকার জীবনে ফিরে আসেন।

তৃতীয়জন হলেন, যিনি একাগ্রচিত্তে ইবাদতে মনোযোগী হন। তিনি এ মাসকে গনিমত মনে করে এর মধ্যে বেশির চেয়ে বেশি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেন। ফলে তার আগের ও পরের জীবনে বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তৃতীয় প্রকারের এ ব্যক্তিই আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবি।

রমজানে সাহাবায়ে কেরামের আমল ছিল বর্ণনাতীত। তারা রমজান আসার আগ থেকেই নিজেদের আমলের বিন্যাসের জন্য সময় নির্ধারণ করতেন এবং কোনোভাবে সময় নষ্ট হতে দিতেন না। রমজানে বিশেষ যে ইবাদতগুলোর প্রতি তারা গুরুত্বারোপ করতেন এ সম্পর্কে কিছুটা বিবরণ দেওয়া হলো।

অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা: আবু জর (রা.) সাথীদের নসিহত করে বলতেন, ‘যখন তোমরা রোজা রাখ, তখন যতটুকু সম্ভব অপ্রয়োজনীয় কথা থেকে বিরত থাক।’ এ বর্ণনার বর্ণনাকারী তালিক যখন রোজাবস্থায় থাকতেন তখন ঘর থেকে শুধু নামাজের জন্য বের হতেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা)।

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘যখন তোমরা রোজা রাখবে, তখন তোমাদের কান, তোমাদের চোখ, তোমাদের জবান মিথ্যা ও গোনাহ থেকে রোজা রাখবে। খাদেমকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। রোজার দিন তোমাদের গাম্ভীর্যভাব নিয়ে থাকবে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ৯৮৭৩)।

ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘রোজা শুধু পানাহার বর্জনের নাম নয়; বরং রোজা মিথ্যা, বাতিল ও বেহুদা কসম খাওয়া থেকে বর্জনের নামও।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ৯৮৭৫)। এ ধরনের কথা আলী ইবনে আবি তালেব (রা.) থেকেও বর্ণিত আছে। (প্রাগুক্ত: ৯৮৭৭)।

দিনের বেলায়ও মসজিদ আবাদ: ইবনে আবি শায়বা আবুল মুতাওয়াক্কিল থেকে বর্ণনা করেন, ‘আবু হুরাইরা (রা.) এবং তার সাথী রোজা রাখলে, মসজিদে বসে থাকতেন।’ (আন-নিহায়া ফি গারিবিল হাদিস, মাদ্দাহ: যারাবা)। বহু সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম মাহে রমজানে ইতেকাফ করতেন। বিশেষ করে শেষ দশকে।

অসহায় ও মেহমানদের দাওয়াত: সাহাবায়ে কেরাম (রা.) আসহাবে সুফফাদের খাবার দিতেন। কারণ, তারা মুসলমানদের মধ্যে জীবনযাপনের দিক থেকে দুর্বল ছিলেন। মসজিদে নববিতে পড়ে থাকতেন। ওয়াসেলা ইবনে আসকা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রমজান এলে আমরা সুফফায় থাকতাম, আমরা রোজা রাখতাম, যখন ইফতার করতাম, তখন আমাদের একেকজনের কাছে একজন এসে নিয়ে গিয়ে রাতের খাবার খাওয়াতেন।’ (হিলয়াতুল আওলিয়া: ৩/২২)।

সাহাবায়ে কেরাম প্রতিনিধি দল এবং মেহমানদের জন্য খাবার পাকাতেন। আলকামা ইবনে সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ সাকাফি স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন, ‘আমরা প্রতিনিধি দলের সঙ্গে থেকে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসতাম। তিনি আমাদের জন্য মুগিরা ইবনে শু‘বার ঘরের পাশে দুটি তাবু টানিয়ে দিতেন। বেলাল (রা.) আমাদের কাছে ইফতার নিয়ে আসতেন। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, “বেলাল, রাসুল (সা.) ইফতার করেছেন? বেলাল (রা.) বলতেন, হ্যাঁ, আমি তোমাদের কাছে রাসুল (সা.)-এর ইফতার করার পরই এসেছি এবং আমরাও খেয়ে এসেছি। বেলাল (রা.) আমাদের কাছে সেহরিও নিয়ে আসতেন।’ (আল মুজামুল কাবির লিততাবরানি: ৪২০০)।

আবদুল্লাহ ইবনে রাবাহ (রা.) বর্ণনা করেন, ‘কয়েকজন প্রতিনিধি দল মুয়াবিয়া (রা.)-এর কাছে এলেন। তখন রমজান মাস ছিল। আমাদের কেউ কেউ অল্প খাবার তৈরি করতেন। আবু হুরাইরা (রা.) খুব করে আমাদের হাওদাতে ডাকতেন। অতঃপর আমার সাক্ষাৎ আবু হুরাইরা (রা.)-এর সঙ্গে হয়। আমি বললাম, আজ রাতে আমার এখানে দাওয়াত নেন। আবু হুরাইরা (রা.) বললেন, আপনি আমার ওপর অগ্রগামী হয়েছেন। আমি বললাম, জি, হ্যাঁ, অতঃপর আমি লোকদের দাওয়াত দিলাম।’ (মুসলিম: ১৭৮০)।

সেহরি ও ইফতারিতে দাওয়াত: তাউস (রহ.) থেকে বর্ণনা আছে, ‘আমি ইবনে আব্বাস (রা.) কে বলতে শুনলাম, ওমর (রা.) সেহরিতে আমাকে খাওয়ার জন্য ডেকেছেন। এরই মধ্যে লোকদের হট্টগোল শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী হচ্ছে? আমি বললাম, মানুষ মসজিদ থেকে বের হচ্ছে।’ (মুখতাসারু কিয়ামিল লাইল: ৯৭)।

মূলত লোকেরা যৌথভাবে সেহরি খাওয়ার পর বের হচ্ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর সঙ্গে কখনো তার শাগরেদ সেহরি খেতেন, কম-বেশি যা কিছু থাকত। তিনি বিলম্বে সেহরি খেতেন। ইবনে আবি শায়বা আমের ইবনে মাতার থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘আমি আবদুল্লাহর কাছে তার ঘরে এলাম, তিনি সেহরির অতিরিক্ত খাবার বের করলেন। আমরা তার সঙ্গে সেহরি খেলাম। নামাজের জন্য ইকামত বলা হলে আমরা বের হলাম এবং তার সঙ্গে নামাজ পড়লাম।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ৯০২৪)।

সিলাহ ইবনে যুফার বলেন, আমি হুজাইফা (রা.)-এর সঙ্গে সেহরি খেলাম। তারপর মসজিদে চলে গেলাম। দুই রাকাত ফজরের সুন্নত পড়লাম, অতঃপর নামাজের জন্য ইকামত বলা হলে আমরা নামাজ পড়লাম।’ (নাসায়ি: ২১৫৪)।

কুরআনের মাসে তিলাওয়াতের আধিক্য: সাহাবায়ে কেরাম রমজানে অধিক পরিমাণে কোরআন তিলাওয়াত করতেন। কিছু কিছু সাহাবায়ে কেরাম শুধু কোরআন তিলাওয়াতের জন্য অবসর হয়ে যেতেন। এটাকেই নিজের ব্যস্ততা বানাতেন। মারওয়াজি (রহ.) কাসেম (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন, ইবনে মাসউদ (রা.) সাধারণত এক জুমা থেকে অপর জুমা পর্যন্ত পূর্ণ কোরআন খতম করতেন। রমজানে প্রতি তিন দিনে এক খতম দিতেন। এর মধ্যে দিনে খুব সময়ই ব্যয় করতেন।’ (আসসুনানুল কোবরা লিলবায়হাকি: ২/৩৯৪)।

আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর মামুল ছিল, রমজানে দিনের শুরুভাগে কোরআন তিলাওয়াত করতেন, সূর্য উদিত হয়ে গেলে শুয়ে পড়তেন।’ (লাতাইফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা: ১৭১)।

রাতের আমল: সাহাবায়ে কেরাম সারা বছর নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন। রাতের একভাগ আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত করতেন। অবশ্য রমজানে প্রায় পুরো রাত ইবাদতে ব্যয় করতেন। নফল নামাজে দীর্ঘ তিলাওয়াত করতেন। এক তৃতীয়াংশ, অর্ধেক কিংবা রাতের বেশির ভাগ সময় তিলাওয়াতে কোরআন, নামাজ, জিকির-আজকার ও ইস্তিগফারে ব্যয় করতেন।

আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আমর ইবনে হাজম (রহ.) থেকে বর্ণিত, ‘আমি আবু জর গিফারি (রা.) কে বলতে শুনলাম, আমরা রমজানে রাতের নামাজ থেকে ফিরে এসে খাদেমদের তাড়াতাড়ি খাবার আনার জন্য বলতাম, যেন সুবহে সাদেক না হয়ে যায়।’ (মোয়াত্তা ইমাম মালেক: ১/১১৪)।

শেষ দশকের আমল: রমজানের শেষ দশকের ইবাদতে সাহাবায়ে কেরামের আগ্রহ-উদ্দীপনা অনেক বেড়ে যেত। নিজেও ইবাদতে থাকতেন এবং পরিবার-পরিজনকেও রাতে জাগিয়ে দিতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) শেষ দশকে পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। যেমনটা রাসুল (সা.) করতেন। মুজাহিদ (রহ.) বলেন, ‘ওমর (রা.) শেষ দশকে পরিবারকে জাগিয়ে দিতেন।

সেহরিতে সাহাবায়ে কেরামের আমল ছিল বিলম্বে সেহরি খাওয়া। বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, সেহরি শেষ করা এবং ফজরের আজানে ৫০-৬০ আয়াতের ব্যবধান থাকত। খাওয়ার কিছু না থাকলে এক ঢোক পানি পান করে নিতেন। কেননা সেহরি এ উম্মতের বৈশিষ্ট্য। ইফতারে সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য ছিল, মাগরিবের আজান হতেই খেজুর খেয়ে নিতেন, খেজুর না থাকলে পানি দিয়ে ইফতার করতেন। অথবা যা কিছু নাগালে থাকত এ দিয়ে ইফতার করতেন। ইফতারের সময় সুন্নতসম্মত দোয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন।

বদান্যতা ও দানশিলতা: এ বরকতময় মাসে সাহাবায়ে কেরামের দানশীলতা তুঙ্গে থাকত। সাধারণত নিজের ওপর অন্যদের প্রাধান্য দিতেন। নিজে ক্ষুধার্ত থাকতেন। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সাহাবায়ে কেরামের এ গুণের প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে ঈদের দিনে সদকায়ে ফিতর ছাড়াও গরিব-অসহায় মানুষদের মাঝে এত দান করতেন, যাতে কেউ এ দিনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে সাহাবায়ে কেরামের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রমজানের প্রত্যেকটা আমল যথাযথভাবে করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: শিক্ষক হাদিস ও ফতোয়া বিভাগ, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ