ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

গারো পাহাড়ের প্রেমে...

প্রকাশনার সময়: ১০ অক্টোবর ২০২১, ০৭:০৩
ফাইল ছবি

ছাত্রজীবনে একজন বন্ধু পেয়েছিলাম, যার বাড়ি শেরপুর জেলায় গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। বহুদিন তার কাছে গারো পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্যের মনকাড়া বর্ণনা শুনেছি মন্ত্রমুগ্ধের মতো। পাহাড়ের উঁচু-নিচু টিলা, খাঁদ, ঝর্ণা, ঝিরি, নয়নাভিরাম নান্দনিকতা, নানা প্রজাতির গাছের জঙ্গল, বন্যহাতি, শুকর, হরিণ, চিতাবাঘ, সবুজ টিয়া, ময়না, মথুরা, সবুজ ঘুঘু, বিচিত্র হিংস্র প্রাণীদের আনাগোনা ইত্যাদির গল্প আমাকে বিমোহিত করে ফেলত। শুনতে শুনতে কখন যে হারিয়ে যেতাম গারো পাহাড়ের অথৈ গহিনে, পথ হারানো শ্বাপদসংকুল জঙ্গলে, গা ছমছম নিরুদ্দেশে।

সম্বিতহারা আনমনা মনে অজান্তেই কল্পনার ফানুস উড়িয়ে ঘুরেফিরে দেখে দেখে আসতাম প্রিয় গারো পাহাড়ের নৈসর্গিকতা, অনবদ্য নান্দনিকতা।

বর্ণনার রং-তুলির আঁচড়ে কতবার মনের গহিনে প্রলম্বিত আলেয়ানে এঁকেছি গারো পাহাড়ের বুক চিরে তির তির করে বয়ে চলা, ঝিনাই, ভোগাই, সোমেশ্বর নদীর বালুকা মণ্ডিত কাকচক্ষু কালোজলের স্বচ্ছ স্রোতধারা তার কোনো ইয়াত্তা নেই।

আর যে জিনিসটা আমাকে খুব করে কাছে টানত, পুলকিত করত, তা হলো এখানকার আদিবাসী গারো সম্প্রদায়। বুনো জন্তু-জানোয়ার ঘেরা নিবিড় বনাঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ জীবনধারার অধিকারী উপজাতি মানুষদের জীবনাচরণ স্বচক্ষে দেখার এক সীমাহীন আকাক্সক্ষা তিল তিল করে গ্রথিত হয়, প্রথিত হয়, বেড়ে ওঠে আমার সর্বান্তকরণে। কল্পনার চোখে প্রত্যুষে-দিবসে দেখি ভিন্নতর জীবনবোধের মানুষগুলোর সংগ্রামী পাংশুমুখের ক্লিষ্ট দিনচলা। দূর পাহাড়ের চূড়ায় বসতির ষোড়শী বালিকার পাহাড়ি ঝর্ণা হতে পানি সংগ্রহের দৃশ্য আমি তন্ময় হয়ে দেখি অপার্থিব সৌন্দর্যকাতর ব্যাকুলতায়। স্রোতবাহী ঝিরিতে নেমে সদ্য স্নাত রমনীর নৈবেদ্য যেন স্বর্গীয় সংকলন।

আমি বিভোর হই গারো পাহাড়ের সৌন্দর্যময়তায়, নিমগ্ন হই এর দুর্নিবার প্রেমে। সে-ই থেকে গারো পাহাড় নামটি আমার হৃদয়হারী অনবদ্য এক শ্বাশত প্রেমের অব্যক্ত কথামালা।

কর্মের প্রয়োজনে আজ এলাম গারো পাহাড়ে। শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতি ও শেরপুর সদর উপজেলার টিলা, নাদি, ঝর্ণা, পাহাড় বেষ্টিত পাহাড়ি জনপদে। সবুজ বন পাহাড়ের নৈসর্গিকতা উপভোগ করতে করতে বারবার ফিরে ফিরে দেখছিলাম গল্পে শোনা, কল্পনার রঙে উপজীব্য চিরচেনা আমার প্রেমের পাহাড়, এখানকার মানুষ ও তাদের জন্য জীবনের অনুষঙ্গগুলো।

এখানে মানুষে-হাতিতে দ্বন্দ্ব। হাতির বিচরণ ও চরণে নিষ্পেষিত জনজীবন। জনপদে বিরাজিত মূর্তিমান আতঙ্কের নাম বিদ্যমান শতাধিক বুনো হাতি।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সুউচ্চ পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে বিস্তৃত এ পার্বত্য বনজ জনপদে দল বেঁধে নেমে আসে পাহাড়ি বন্য হাতির পাল। একেক ঝাঁকে পঞ্চাশ থেকে দেড়শ’ পর্যন্ত হাতি দেখা যায়। কিছু কিছু ছোট ছোট দল স্থায়ীভাবে বসবাস করে গারো পাহাড়ে। পাহাড়ের হাতিদের আক্রমণে মাঝে মাঝে নিহত হয় জনপদের অধিবাসীরা, আহত হয়ে পঙ্গু হয় অনেকে, বিনষ্ট হয় সুখের স্বপ্ন। কৃষি ফসলসহ গৃহস্থালি ও ঘরবাড়ি বিনষ্টের ঘটনা এখানকার নিত্যসঙ্গী। ফলে মানুষের আক্রোশ বৃদ্ধি পাচ্ছে হাতিসহ বন্যপ্রাণীর প্রতি, বন্যপ্রাণীরাও ক্ষিপ্ত হচ্ছে মানুষের বন্য অবস্থানের প্রতি। মুখোমুখি অবস্থান উভয়ের জন্য সৃষ্টি করেছে এক দুরাতিক্রম্য সংকটের।

পরিকল্পনা করলাম মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব নিরসনের মাধ্যমে হাতি টিকে থাকার স্থায়ী ব্যবস্থাপনার। তাই স্বল্প মাত্রার বৈদ্যুতিক শক দিয়ে পাওয়ার ফেন্সিংসহ বায়োফেন্সিং করা হবে জনপদের হাতির গমন এলাকায়। গড়ে তোলা হবে হাতি ও মানুষের সহাবস্থানের এক শান্তিময় সুন্দর সুবিশাল গারো পাহাড়। সফলতা ও সার্থকতার সেই দিনটির অপেক্ষায় রইলাম।

লেখক: বন সংরক্ষক, বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল ঢাকা

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ