ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আশিকের রয়েছে ভয়ংকর বাহিনী

প্রকাশনার সময়: ২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০৬:০৩

কক্সবাজার পৌরসভার ১১ নং ওয়ার্ডের মধ্যম বাহারছড়ার মৃত মাস্টার আবদুল করিমের ছেলে আশিকুল ইসলাম আশিক (২৯)। পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর থানায় হত্যাচেষ্টা, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক, অস্ত্র ও দ্রুত বিচার আইনে ১৭টি মামলা রয়েছে। তাকে শহরের হোটেল মোটেল জোনের ব্যবসায়ীরা চেনে অপরাধ জগতের বাদশা হিসেবে। তাকে প্রধান আসামি করে ও তার তিন সন্ত্রাসী গ্রুপের তিনজনের নাম উল্লেখ করে কক্সবাজার সদর থানায় গত বৃহস্পতিবার রাতে ধর্ষণ মামলা করেছেন পর্যটক পরিচয়ে এক নারীর স্বামী। ওই মামলার প্রধান আসামি আশিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পর্যটন এলাকা কক্সবাজার শহরের ত্রাস হিসেবে আট বছর আগেই সূচনা হয় আশিকুর ইসলাম ওরফে আশিকের। ২০১২ সালের দিকে ছিনতাইকারী হিসেবে পুলিশের খাতায় নাম উঠে তার। এরপর একের পর এক ছিনতাই, চাঁদাবাজি, হোটেল দখল, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ে নেমে পড়ে এ ছিনতাইকারী। ভারী হতে থাকে তাদের গ্রুপ। বর্তমানে কক্সবাজারের ভয়ংকর গ্রুপ হিসেবে গ্রুপটি। গ্রুপে রয়েছে শীর্ষ ১০ অপরাধী। যাদের বিরুদ্ধে ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ ও মাদকের অভিযোগ ও মামলা রয়েছে। আশিক গ্রুপের অনেক সদস্য বিভিন্ন মামলায় কারাগারেও গিয়েছিলেন। কারাগার থেকে বের হয়ে একই দলে যোগ দেন তারা। দল বেঁধে মোটরসাইকেলযোগে গভীররাতে হোটেল মোটেল জোন এলাকায় তাদের বিচরণ। গোয়েন্দা সংস্থার একটি দফতরেও আশিক গ্যাংয়ের বিষয়ে তথ্য রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী কিংবা আশীর্বাদপুষ্ট হিসেবে এরা পরিচিত। সাদ্দামের সঙ্গে তাদের অনেক ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সর্বশেষ ২১ ডিসেম্বর সাদ্দাম হোসেনের সেলফিতে বন্দি হন আশিক ও তার সঙ্গীরা। সভাপতি সাদ্দামের মাধ্যমেই সন্ত্রাসীরা সখ্য গড়ে তোলেন কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের সঙ্গে। সাংসদ কমলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কয়েকটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

অনুসন্ধানে ও পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে আশিকুর ইসলাম কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া এলাকার মৃত করিমের ছেলে। তার বিরুদ্ধে প্রায় ১৭টি মামলা রয়েছে। এরই মধ্যে ৫ বার আটকও হয়েছিলেন। তবুও থেমে থাকেনি তার অপকর্ম। তার সঙ্গী ইস্ররাফিল হুদা জয়া। জয়া বাহারছড়া এলাকার সন্ত্রাসী শফির ছেলে। শফি শহরের নাম্বার ওয়ান সন্ত্রাসী হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন। আশিকের সঙ্গে জয়াও বেশ কয়েকবার আটক হয়েছিল। তার সঙ্গে রয়েছেন মেহেদী হাসান বাবু ওরফে গুন্ডিয়া। বাবু বাহারছড়া এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে। আবুল কাশেম ঝাউতলা এলাকার হোটেল সাগরগাঁও এর নাইট গার্ড। সন্ত্রাসী আশিকের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে রয়েছে বাহারছড়া এলাকার আসমত আলীর ছেলে মোবারক আলী। মোবারকের বিরুদ্ধেও রয়েছে পাঁচের অধিক মামলা। এসব মামলায় আটক হয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন ৪ বারের অধিক। আশিকের উত্থান মোবারকের হাত ধরে হলেও অপকর্মে তাকে ছাড়িয়ে যান তিনি। এ ছাড়া মোবারকের অস্ত্রের জোগানদাতা শহরের শিবির ক্যাডার সালাউদ্দিন। সালাউদ্দিনের কাছ থেকে নিয়মিত অস্ত্র কিনত মোবারক। আশিক বাহিনীর অন্যতম অর্থ জোগানদাতা কক্সবাজার বাস টার্মিনাল এলাকার আবুল কালাম ওরফে বড় দা। আবুল কালাম কক্সবাজার শহরের শীর্ষ ইয়াবা কারবারি হিসেবে পরিচিত। বড় দা’র বাড়ি এক সময় টেকনাফ থাকলেও বর্তমানে কক্সবাজারে। টেকনাফে এক ব্যক্তিকে হত্যার পর কক্সবাজারে পালিয়ে আসে আবুল কালামের পরিবার। কক্সবাজারে বসে টেকনাফের ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলাও রয়েছে। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারিও আবুল কালাম। আশিকের ছিনতাইকারী পার্টনার বাহারছড়া এলাকার জোবাইর। এমনকি আশিকের ইয়াবা পৌঁছে দেন জোবাইর। আশিকের সহযোগী রয়েছে বাহারছড়া এলাকার বিজয় দাশ ও ইরফান। ইরফান এলাকায় খুচরা ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ পরিচিত। একইসঙ্গে বিজয় দাশও আশিকের ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। দীর্ঘদিন ধরে আশিক ও মোবারকের সহযোগী হিসেবে রয়েছেন বাহারছড়া এলাকার আরিফুল ইসলাম ওরফে ছোট আরিফ। আশিক গ্রুপের এসব অপকর্ম ও ইয়াবা কারবারের অর্থ জোগানদাতা হিসেবে রয়েছে শহরের গাড়ির মাঠ এলাকার নুর নবী শাহিন। শাহিন শহরের রহস্যজনক হিসেবে চিহ্নিত। তার দৃশ্যমান কিছুই না থাকলেও জীবনযাপন আলিশান। শাহিনের স্থায়ী বাড়ি টেকনাফের হ্নীলা রঙ্গিখালী এলাকায়। দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার শহরে অবস্থান করে জীবনযাপন করছেন কোটিপতি স্টাইলে। বেশির ভাগ আশিক ও মোবারকের ছবিতে দেখা যায় শাহিনকে।

একটি সূত্রে জানা গেছে কক্সবাজার শহরে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে আশিকসহ তার সহযোগীরা আশ্রয় নিতেন পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড সমিতি পাড়া এলাকার আজিজুল হক আরজুর বাড়িতে। আরজু সমিতিপাড়াস্থ ফদনার ডেইল এলাকার হাসিম মাঝির ছেলে। আরজুও একজন চিহ্নিত মাদক কারবারি। ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে আটকও হয়েছিলেন আশিকের সহযোগী আরজু।

গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন সন্ত্রাসী আশিকুল ইসলামের বেপরোয়া জীবনযাপনের পেছনে রয়েছে রাসেল নামের এক ব্যক্তি। শহরের বিভিন্ন অপকর্মে তদবির করে আশিককে ছাড়িয়ে নিতেন তিনি। গাড়ির মাঠ এলাকার সাত্তার ও রোজিনা নামের এক দম্পতির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে আশিককে আশ্রয়দাতা হিসেবে। সাত্তার ও রোজিনা চিহ্নিত মাদক কারবারি। যার কারণে আশিকের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ১৫ দিন আগে আশিককে জামিনে বের করে আনেন সাত্তার ও রোজিনা।

কক্সবাজারের এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় আশিকের তথ্য খুঁজতে গিয়ে ভয়ংকর অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। তার অপরাধের শেকড় যে কত গভীরে তা বলার ভাষা নেই। সব চিহ্নিত অপরাধীর সঙ্গে তার যোগাযোগ। রয়েছে নিজস্ব বাহিনীও; যারা চিহ্নিত ছিনতাইকারী, মাদক কারবারি ও দখলবাজ। এমনকি কলাতলীর মোড়ে একটি হোটেল দখলে নেয় আশিক বাহিনী। যে হোটেল থেকে জেলা ছাত্রলীগের এক নেতার মাধ্যমে ৬ লাখ টাকা নেন আশিক ও তার সহযোগীরা। এ ছাড়া কটেজ জোনে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ আশিকের পুরো বাহিনীর বিরুদ্ধে। আশিকসহ তার বাহিনীর সকল চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কটেজ জোনের এক ব্যবসায়ী বলেন, আশিক যেসব কটেজে ঢুকে গণ্ডগোল কিংবা লুটপাট চালান সেসব হোটেল অবৈধ কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত। এ কারণে হোটেল মালিকরা আইনের আশ্রয় নেন না।

পুলিশ, আদালত ও স্থানীয় সূত্র জানায়, কিশোর বয়সেই আশিকের অপরাধ জগতে পথচলা শুরু। ছোটবেলা থেকে আশিক মারামারি, চুরি, ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। ২০১১ সালের ২০ আগস্ট তার বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর থানায় মারামারি আইনে প্রথম মামলা দায়ের হয়। এর ১০ মাস পর ২০১২ সালের ২০ জুলাই একই থানায় তার বিরুদ্ধে হত্যা চেষ্টায় গুরুতর জখম আইনে মামলা হয়। এর পর ২০১৪ সালের ১৪ জানুয়ারি একই থানায় একই ধারায় আরেকটি মামলা হয়। একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ডাকাতির চেষ্টার দায়ে অস্ত্র আইনে একটি এবং হত্যা প্রচেষ্টার দায়ে অপর একটি মামলা হয়। পরের বছর ২০১৫ সালের ৫ মার্চ তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা হয়। ওই বছরের ২১ নভেম্বর আশিকের বিরুদ্ধে সদর থানায় অস্ত্র ও ডাকাতির প্রস্তুতি আইনে দুটি মামলা হয়। ২২ নভেম্বর ফের আরেকটি ডাকাতির মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। অপরাধীদের বাদশা আশিকের বিরুদ্ধে ডাকাতি আইনে আবারো মামলা হয় ২০১৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। একই বছরের ১৪ অক্টোবর ফের অস্ত্র আইনে ও পরদিন মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। চলতি বছরের ৩০ জুন আশিকের বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা চেষ্টা মামলা ও ৭ নভেম্বর ডাকাতির প্রচেষ্টার এবং সর্বশেষ ২৩ ডিসেম্বর এক গৃহবধূকে ধর্ষণ মামলা হয়।

র্যাব জানিয়েছে, অন্ধকার জগতের এমন কোনো দিক নেই যেখানে আশিকের বিচরণ নেই। ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে পর্যটকদের জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে নেয়াই ছিল আশিকের অন্যতম পেশা। স্থানীয় লাইট হাউজে বসে এসব কাজ চালাতেন তিনি। এ ছাড়া স্থানীয় মাদক ব্যবসা, অস্ত্র কারবার ছাড়াও চুরি ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসব অভিযোগে বিভিন্ন সময় তার বিরুদ্ধে ১২টি মামলা হয়। এসব মামলায় পাঁচবার গ্রেফতারও হন।

২০১১ সালে এসএসসি পাসের পর বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িত ছিলেন আশিক। নিজে গ্যাং বাহিনী খুলে শহরের সুগন্ধা এলাকায় ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট জোর করে কম টাকায় ভাড়া নিয়ে দ্বিগুণ ও তিনগুণ দামে ভাড়া আদায় করতেন। তাছাড়া ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অবৈধভাবে দখল করে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

র্যাব জানায়, গ্রেফতার আশিক কক্সবাজারে পর্যটক এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের মূল হোতা। এ চক্রের সদস্য ৩০-৩৫ জন। আশিক বিগত ২০১২ সাল থেকে কক্সবাজার পর্যটক এলাকায় বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। প্রথম ২০১৪ সালে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন পুলিশের হাতে। তার সিন্ডিকেট পর্যটন এলাকা কক্সবাজারে চুরি, ছিনতাই, অপহরণ, জিম্মি, চাঁদাবাজি, জবরদখল, ডাকাতি ও মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। পর্যটন এলাকায় বিভিন্ন হোটেলে ম্যানেজারের সঙ্গে যোগসাজশে ট্যুরিস্টদের ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইল করতেন।

কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এসএম সাদ্দাম হোছাইন বলেন, আমি ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পর অনেকেই আমার সেলফি তুলতে আসে। নেতা হিসেবে আমি বারণ করতে পারি না। ওই নারীকে ধর্ষণে অভিযুক্তদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই।

কক্সবাজার-রামু আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, ‘আমি একজন এমপি। অনেকেই অনেক অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে সেলফি তোলে। তাদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না।’

তিনি বলেন, ‘অপরাধী যেই হোক সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ করব।’

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় এরই মধ্যে আশিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই সঙ্গে আশিকের গ্রুপে যেসব অপরাধী রয়েছেন তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্রুত সময়ে সব অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হবে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ