ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

দুর্বৃত্তরা পেশাগত ছদ্মবেশ নিয়েছে সাংবাদিকতায়

প্রকাশনার সময়: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৭:৫৬

উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগে জঙ্গি, সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্তরা পেশাগত ছদ্মবেশ নিয়েছে সাংবাদিকতায়। প্রকৃত সাংবাদিকরা তাদের পেশা নিয়ে মহাবিপাকে। সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্তরা প্রকৃত পেশাক আড়াল করতে সাংবাদিকদের সাথে মিশে গেছে। তারা নিজেদের বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, অনলাইন টিভি ও নিউজ পোর্টালের সাংবাদিক দাবি করে থাকেন।

২০০১ সালের পর দেশের উত্তরাঞ্চলে জঙ্গি মৌলবাদী সংগঠনগুলোর উত্থান ঘটে। দিনাজপুরে মন্দিরে হামলা ও পুরোহিতকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক অস্ত্রও বিপুল পরিমাণ বুলেটসহ লালমনিরহাট শহরের বানভাসার মোসাবেরুল নামের এক যুবক আটক হয়। তিনি এখনো কারাগারে রয়েছেন। তার স্বীকারোক্তি মতে কয়েক যুবককে পুলিশ আটক করেছিল। পরে তারা ছাড়া পেয়ে যায়। এমনকি পুলিশ তদন্ত হতে সুকৌশলে বাদ পড়ে যায়। সেই সময় লালমনিরহাটে কর্মরত কয়েকজন সংবাদ কর্মীকে জঙ্গি সংগঠনের পক্ষে পত্র দিয়ে সহযোগিতা চায়। তাদের সাথে থাকলে গাজীর মতো বাঁচতে পারবে বলে জানায়। সে সময় তারা তিস্তার দুর্গম চরে ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করেছিল। সেখানে পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে শারীরিক কসরত করার সময় তিস্তার চরে একটি এনজিও এর কার্যক্রমে অতিথি হিসেবে যাওয়ার সময় অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আজিজ বীরপ্রতীকের নজরে বিষয়টি আসে। সেই সময় তাকে উদ্ধৃতি দিয়ে খবর প্রকাশ হয়। হাতীবান্ধায় বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণ ঘটে দুইজন নিহত হয়ে ছিল।

উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট, রংপুর, দিনাজপুর জেলায় মারাত্মক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এই অস্থিরতাকে উষ্কে দেয় তৎকালীন সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী জামাত নেতা আলী হাসান মোজাহিদ ( পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধী মামলায় সাজা ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর)। তিনি জেলায় ঘন ঘন এসেছিলেন। রাজনৈতিক কর্মসূচি, কর্মী, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানোর কথা বলে গভীর রাতে সার্কিট হাউস হতে একা কোনো প্রটোকল ছাড়া বেড়িয়ে পড়তেন।

রাজনৈতিক বিশেষ পরিস্থিতিতে ২০০৬ সালের পরে সেনা সমর্থিত তত্বাবোধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। সেই সময় স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার পরিসর কিছুটা হলেও সঙ্কুচিত হয়ে আসে। সেই সময় লালমনিরহাটের মহিষখোচায় জঙ্গি বিরোধী অভিযান করে যৌথবাহিনী কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আটক হয়। সেই সময় স্বাধীনতা বিরোধী পরিবারের সন্তান এক ব্রিগেডিয়ার জঙ্গিদের সহায়তা করা ব্যক্তিদের বাঁচাতে এগিয়ে আসে। তার হস্তক্ষেপে মহিষখোচার জঙ্গি অপশক্তির ব্যক্তিরা লালমনিরহাট শহরের কারিগরি কলেজের সেনা সমর্থিত তত্বাবোধায়ক সরকারের অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পে এসে গণ মুচলেকা দিয়ে ছিল। যা সেই সময় ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত ঘটনার একটি। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে জামাত শিবির সিন্ডিকেটের এক মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সরকারের সাবেক মন্ত্রীর ছত্রছায়া পেয়ে জঙ্গি, মৌলবাদী চক্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়।

সাবেক মন্ত্রীর ছত্রছায়া জঙ্গি মৌলবাদী চক্রটি উত্তরাঞ্চলে জেলা গুলোতেগড়ে তুলে কথিত থিমপাক্, ভেজিটেবল কোল্ড স্টোরসহ নানা প্রতিষ্ঠান। সেখানে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে থাকে। সেই সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক মন্ত্রীর এপিএসের সহায়তায় জঙ্গি মৌলবাদী ও স্বাধীনতা বিরোধী পরিবারের সন্তানরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মিডিয়ায়। বাবার নামে এখনো জঙ্গি মামলা বিচারাধীন ছেলে সাংবাদিক, বাবা কুখ্যাত রাজাকার ছিল, তার নিষ্ঠুরতার কাহিনী এখনো সাধারণ মানুষের মুখে মুখে তার। ছেলে একটি মিডিয়া হাউজের রংপুর ব্যুরোচিপ।

কালীগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান মাহাবুবুজ্জামান আহম্মেদ জানান, তুষভান্ডার রেলওয়ে স্টেশনের পাশে মুক্তিযোদ্ধা হত্যার দায়ে এক কুখ্যাত রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করে। সেই অবাঙ্গালী মৃত রাজাকারের স্ত্রীর ছেলে এখন হায়দারী সাংবাদিক। তারমতে রাজাকার কুখ্যাত পরিবারের সদস্য, দুর্বৃত্তরা, সন্ত্রাসীরা নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে তারা 'কভার জব' বা পেশাগত ছদ্মবেশ নিয়েছেন সাংবাদিকতা পেশাকে। কেউ কেউ আবার বেসরকারি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করেন। তাদের অনেকে লালমনিরহাট জেলায় জামাত-শিবিরের রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন। ছিলেন হিংস্র প্রকৃতির। কেউ কেউ নানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে বাটপারি করে সাধারণ মানুষের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে গেছে এ জেলা হতে। তাদের অনেকে এখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে শতশত কোটি টাকার মালিক।

বিএনপি জামাত জোট সরকারের আমলে দেশে প্রকৃত সাংবাদিকদের নিধনযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। সাংবাদিক বালু, সাংবাদিক মানিক শাহ, সাংবাদিক সামছুর রহমানসহ প্রায় অর্ধশত সাংবাদিক নির্মম পৈশাচিক হত্যাকান্ডের স্বীকার হয়। সাংবাদিকতা পেশায় ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে মফস্বল সাংবাদিকতা পেশা হতে অনেক মেধাবী ও পরিচ্ছন্ন মানুষ সরে গেছে। রাজধানীর বুকের অনেক সাংবাদিক সম্পূর্ণ ভাবে কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তারা বিদেশে পাড়ি জমায়। দেশে সাংবাদিকতা পেশা ছেড়ে বিদেশের মাটিতে অন্য কোনো পেশায় জড়িয়ে উন্নত জীবনযাপন করছে। দেশে থেকে নিজেদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ব্যাপক ঝুঁকি নিতে চায়নি।

বীরমুক্তিযোদ্ধা গেরিলা লিডার ড. এসএম শফিকুল ইসলাম কানু জানান, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্রহাতে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেছি, একই সাথে রণাঙ্গন পত্রিকায় কাজ করেছি।’ তিনি দীর্ঘদিন বিটিভি'র সংবাদদাতা ছিলেন। বর্তমানে সাপ্তাহিক লালমনিরহাট বার্তার সম্পাদক ও দৈনিক ইত্তেফাকের লালমনিরহাট জেলা প্রতিনিধি। তিনি জানান, ৬০, ৭০, ৮০ ও ৯০ এর দশক ছিল সাংবাদিকতার স্বর্ণযুগ। এসময় দেশে অনেক মেধাবী ও দেশপ্রেমিক সাংবাদিক বেড়িয়ে এসেছিল। তারপর সাংবাদিকতার ইতিহাস সংস্কৃতি হঠাৎ ভিন্নধারায় হাঁটতে শুরু করে। বর্তমান সময়ে সারাদেশে প্রকৃত সাংবাদিকদের দুরবস্থা। সাংবাদিকতা পেশার আড়ালে ছদ্মবেশে সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্তরা পেশায় এসেছে যাহা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী। এই কারণে ইতোমধ্যে সাংবাদিকতা পেশার মানুষ সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সাংবাদিকতা পেশার আড়ালে ঘটছে নৈতিক কর্মকাণ্ড। যাহা সাংবাদিকতা পেশাকে সংকটে ফেলছে।

লালমনিরহাট জেলার সিনিয়র সাংবাদিক নামপ্রকাশ না করার শর্তে জানান, কেউ কেউ সাংবাদিকতা পেশার আড়ালে দেশের গোয়েন্দা সংস্থা আইডি কার্ড তৈরি করে চাঁদাবাজি করতেও দেখা গেছে। দুই বছর আগে ইসলামী ফাউন্ডেশনের লালমনিরহাটের উপপরিচালকের কাছে এমন একটি চাঁদাবাজি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরাপড়ে দুই সাংবাদিক। তাদের কাছে ভুয়া এনএসআইয়ের কর্মকর্তার পরিচয়পত্র উদ্ধার হয়। এসময় ২/৩ জন তথাকথিত সংবাদকর্মী পালিয়ে যায়। তাদের নামেও আসামি করে মামলা দায়ের হয়েছে। মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।

জার্নালিজম নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালা নেই। কোন কোন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্মীর মতো কিছু মিডিয়া হাউজ ও মিডিয়া কর্মী কাজ করে থাকে। যার কারণে পেশাটি হতে যখন যে সরকার আসে তারা পক্ষপাতিত্ব দুষ্টচক্রে আটকে যায় কোন কোন ক্ষেত্রে। যার উদাহরণ স্বরুপ সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা মামলা সামনে চলে আসে। পৃষ্ঠপোষকতা করেছে জামাত শিবিরের প্রতিষ্ঠিত এনজিও দের। মিঠাপুকুরের এক এনজিও ট্রেনিং না করিয়ে লুটকরে নিয়েছে প্রায় ৯ কোটি টাকা। দৈইখাওয়া, কালীগঞ্জে ভুঁইফোড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে জনসাধারণের কয়েক শত কোটি টাকা জামানত সংগ্রহ করে উধাও হয়ে গেছে।

নয়া শতাব্দী/এসএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ