ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ভাগ্য বদলের অপেক্ষা  

প্রকাশনার সময়: ২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০৭:১৩

এক সময়ের স্বপ্ন এখন বাস্তব। পদ্মা সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচল এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাংলাদেশের ইতিহাসে নিজেদের করা সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট এই সেতু। ভাগ্য বদলের অপেক্ষায় এখন দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। ২০২২ সালের ৩০ জুন পদ্মা সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার কথা রয়েছে। সেতুর বেশিরভাগ কাজই প্রায় শেষ। বাকি শুধু রেল সংযোগের কাজ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সেতু চালু হলে অর্থনীতিতে সরাসরি এর সুফল আসবে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আইএমইডি সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর ৮৯ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। আর্থিক দিক দিয়ে ৮৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। রেল সংযোগ ৪৮ শতাংশ ও আর্থিক ৫১ দশমিক ৮২ শতাংশ হয়েছে। এরই মধ্যে মূল সেতুর কাজ ৯৫ দশমিক ২৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

সেতু প্রকল্পের আওতায় নদী শাসনের কাজের অগ্রগতি হয়েছে সাড়ে ৮৬ শতাংশ। মূল সেতুর মধ্যে ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাব, ২ হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাব ও ৫ হাজার ৮৩৪টি শেয়ার পকেট বসানো হয়েছে। মাওয়া ও জাজিরার ভায়াডাক্টে ৪৩৮টি সুপারটি গার্ডারের মধ্যে ৪৩৮টি এবং ৮৪টি রেলওয়ে আই গার্ডারের মধ্যে ৮৪টিই স্থাপন করা হয়েছে। ১২ হাজার ৩৯০টি প্যারপেট ওয়ালের মধ্যে ১২ হাজার ২৫৪টি স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। সেতুর সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার কাজ এরই মধ্যেই শতভাগ শেষ হয়েছে। সেতুর অবশিষ্ট কাজের মধ্যে ওয়াটার প্রুফিং মেমব্রিনের কাজ ১৩ ভাগ, কার্পেটিং ২ দশমিক ৫ ভাগ, মুভমেন্ট জয়েন্ট ৫৯ ভাগ, ল্যাম্পপোস্ট ৯ দশমিক ১৯ ভাগ কাজ এগিয়েছে। গ্যাস পাইপ লাইন ৪৯ দশমিক ৩৫ ভাগ এবং ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ লাইনের কাজ ৬২ ভাগ এগিয়েছে। মূল সেতুর মোট ৪১টি ট্রাস রয়েছে, যার সবই এরই মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের জুনে পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হবে। ২০২২ সালের ৩০ জুনের মধ্যে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার কথা জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, টার্গেটের মধ্যেই পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হবে। এখন পিচ ঢালাইয়ের কাজ চলছে। সেটা শেষ হলেই শেষ। পদ্মা সেতু ২০২২ সালের জুনে উদ্বোধন হবে, সেটি তো আগেও বলা হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতুর ৮৯ ভাগ অগ্রগতি হয়েছে। আশা করছি, ৩০ জুন বা তার আশপাশের সময়ে যান চলাচলের জন্য ওপেন করে দেয়া হবে।

সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো হলো পদ্মা সেতু। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। দ্বিতল এই সেতুর এক অংশ মুন্সিগঞ্জের মাওয়া এবং অপর অংশ শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যুক্ত। একই সঙ্গে রেল ও গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে এ সেতুটিতে। নির্মাণে মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। বিদেশি ষড়যন্ত্রে নিজস্ব অর্থায়নে কাজ করতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ সরকার।

এই সেতু আগামীতে দেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু ঘিরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন পূরণ হতে চলছে। মানুষের ভাগ্য বদলে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে সেতুটি। খুলছে অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের দ্বার। আরো সহজ হবে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান। এ অঞ্চল হবে দেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোন। পদ্মা সেতু ঘিরে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা বাড়তে শুরু করেছে।

২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পর সরে যায় আন্তর্জাতিক তিনটি সংস্থা— এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এতে কিছুটা বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ সরকার। তবে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করার চ্যালেঞ্জ নেয় সরকার। ওই সময়ে প্রকল্পটির ব্যয় ছিল প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। যা ওই বছরের মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৫০ শতাংশ। ফলে নাগালের বাইরে চলে যায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের স্বপ্ন। পরের ইতিহাস সবার জানা। সব বাধা উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তাতেই কেটে যায় সব অন্ধকার। দুঃসাহসিক এই সিদ্ধান্তে জীবন্ত হয়ে উঠে বাঙালির স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবে ধরা দিচ্ছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।

জানা গেছে, পদ্মা সেতুতে অর্থনীতিতে সরাসরি তিন ধরনের সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। এতে ওই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করবে। বিনিয়োগ বাড়বে। দ্বিতীয়ত, কৃষক সরাসরি উপকৃত হবেন। তাদের উৎপাদিত পচনশীল পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পাঠাতে পারবেন। এতে পণ্যের ভালো দাম পাওয়া যাবে। তৃতীয়ত, এ সেতুর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার হবে। বিশেষ করে ভারতের বাণিজ্য বাড়াতে মোংলা বন্দর ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া পায়রা বন্দরের জন্য এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হবে। এরই মধ্যে পদ্মা বহুমুখী সেতুতে আটটি ল্যাম্পপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর এসব কাঠামো চীন থেকে আনা হয়েছে। গত নভেম্বরে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে সড়ক পথে পদ্মা সেতুর মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ৯৫টি ল্যাম্পপোস্টের কাঠামো নিয়ে আসা হয়েছে। সংযোগসহ সেতুতে মোট ৪১৬টি ল্যাম্পপোস্ট স্থাপন করা হবে। এর মধ্যে মূল সেতুতে ৩২৮টি এবং সংযোগ সেতুতে বসানো হবে ৮৮টি ল্যাম্পপোস্ট।

সেতুর মাওয়া প্রান্তের সংযোগের যে পথ ধরে যানবাহন নামবে সে পথে বসানো হবে ২০টি ল্যাম্পপোস্ট। আর এ প্রান্তের যে পথে যানবাহন উঠবে সেখানে স্থাপন করা হবে ২২টি ল্যাম্পপোস্ট। সেতুর শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যানবাহন নামার পথে ২৪টি ও ওঠার পথে ২২টি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হবে।

গত ১০ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে পদ্মা সেতুর সড়কপথের পিচ ঢালাইয়ের কাজ। পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেতুর সার্বিক অগ্রগতি ৮৭ শতাংশ এবং মূল সেতুর ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্টে পানি নিরোধক স্তর বসানো হচ্ছে না। তাই ভায়াডাক্টের ৬০ মিটার অংশে পিচ ঢালাই করা হয়েছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে সেতুর একে একে ৪১টি স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হয়। তারপর বসানো হয়েছে সড়ক যান চলাচলের জন্য কংক্রিটের স্ল্যাব। পদ্মা সেতুর পিচের পুরুত্ব হবে ১০০ মিলি মিটার। তার পর পার্শ্ব দেয়ালসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা হবে।

প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এ যাবৎ সার্বিক কাজ এগিয়েছে ৮৯ শতাংশ। মূল সেতুর কাজ হয়েছে ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ, নদী শাসনের কাজ হয়েছে ৮৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।

পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার মাধ্যমে ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। একইসঙ্গে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সক্ষমতাও প্রমাণিত হয়েছে। যার ফলে বিশ্বমোড়লরা বাংলাদেশকে বর্তমানে অন্যভাবে মূল্যায়ন করে। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মাথা উঁচু হয়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করেছি। এখন যে কেউ বিনিয়োগের জন্য আসতে পারে। আমরা তাদের স্বাগত জানাব। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসহ মেগা প্রকল্পগুলো আগামীর বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চিত্র। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এগিয়ে চলছি আমরা। এখন শুধু কাজ করে যেতে হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নয়া শতাব্দীকে বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ। এই সেতুটি নির্মাণের ফলে বাংলাদেশে অর্থনীতি অনেকটাই ইতিবাচক ধারায় পরিবর্তন হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সর্বমোট বাজেটের মধ্যে গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৬ হাজার ৪৭৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বা মোট বাজেটের ৮৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। মূল সেতুর কাজের চুক্তিমূল্য প্রায় ১২ হাজার ৪৯৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। যার মধ্যে চলতি বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৫১২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এদিকে, সেতু প্রকল্পের আওতায় নদী শাসনের কাজের অগ্রগতি হয়েছে সাড়ে ৮৬.৫০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৮.৩৭ ভাগ। নদী শাসন কাজের চুক্তিমূল্য ৮ হাজার ৯৭২ কোটি ৩৮ লাখ টাকার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৩১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে পণ্যবাহী যানবাহনের একটা বড় অংশ হবে ভারতের। দেশটির পশ্চিমাংশ থেকে পূর্বাংশে মাল পরিবহন হবে এই পথে। নেপাল ও ভুটানকেও সেতুটিতে যুক্ত করতে পারবে। এতে আন্তঃবাণিজ্য বাড়বে। পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। প্রস্তাবিত পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে নির্দিষ্ট পথের মাধ্যমে দেশের কেন্দ্রের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সরাসরি সংযোগ তৈরি করবে।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ