ঢাকা, রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫

আর কত আহাজারি!

প্রকাশনার সময়: ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০৬:১৩

থেমে নেই অগ্নিকাণ্ড ও গ্যাস বিস্ফোরণে প্রাণহানি। বৃহস্পতিবার ভোররাতে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৪১ জন। এভাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতি বছরই ঘটে হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা। এসব ঘটনায় অকালেই হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। আহত হয়ে অনেকেই সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হচ্ছেন। কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে পরিবারের বোঝা হয়ে দুর্বিষহ জীবন পার করছেন।

তবে এসব অনাকাঙ্কিত দুর্ঘটনা প্রতিরোধের কোনো পদক্ষেপ নেই। প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি ও মামলা হয়, কিন্তু শাস্তি আর হয় না। অবৈধ গ্যাস সংযোগ এবং বিল্ডিং কোড না মেনে ত্রুটিপুর্ণ ও অবৈধ বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে গ্যাস বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও ভবন মালিক ও কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রহস্যজনক কারণে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া যাদের হাতে পর্যবেক্ষণ করা ও ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা তারাও সময় মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ। এ অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম অব্যাহত থাকলে এবং আইন প্রয়োগে কঠোর না হলে পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরো ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে প্রায় ১ লাখ ৬৮ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার প্রায় সবগুলো দায়িত্ব পালনে অবহেলাজনিত কারণে। সারাদেশে ২০০৬ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত গত ১৫ বছর ৫ মাসে অগ্নিকাণ্ড ও গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনায় ১০ হাজার ৫৩০ জন নিহত হয়েছেন। এ সময়ে ছোট বড় ১ লাখ ৬৮ হাজার ২০৩ টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৯ লাখ ২৩০ জন। আহতদের অনেকেই শরীরের দগ্ধ ক্ষত নিয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে জীবনযাপন করছেন। কেউ কেউ সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। ফায়ার সার্ভিস, হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবু নাঈম মো. শহীদুল্লাহ বলেন, এসব ঘটনায় মালিকপক্ষের পাশপাশি নিরাপত্তা দেখার ক্ষেত্রে যাদের দায়িত্ব ছিল, তাদের বিচারের আওতায় আনা এবং ‘ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট’ দেয়ার প্রয়োজন। আবু নাঈম মো. শহীদুল্লাহ আরো বলেন, লঞ্চ এমভি অভিযান-১০ এর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে লঞ্চে আগুন লাগে। দুঘর্টনায় ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর জন্য দায়ী ‘সিস্টে, ফেইলিওর’ই। আমাদের অনেক ভালো ভালো আইন আছে তবে বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বাণিজ্যিক ভবন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান শপিংমল, আবাসিক বহুতল ভবন, লঞ্চ, স্টিমারসহ বিভিন্ন স্থাপনায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ড ও গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। বাণিজ্যিক ভবন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান শপিংমল, আবাসিক বহুতল ভবনে আগুন লাগার কারণ বিল্ডিং কোড না মেনে নকশাবহির্ভূত অবৈধ এবং ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণ এবং অবৈধ গ্যাস লাইন সংযোগ। এসব ঘটনায় প্রতি বছর প্রাণহানি ও হতাহত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। তারপরেও থেমে নেই নকশা বহির্ভূত অবৈধ বহুতল ভবন নির্মাণ। চলছে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ। আছে সংযোগ লাইনের ত্রুটি ও লাইনের লিকেজ।

রাজউক, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার অবহেলা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই আইনের তোয়াক্কা না করে সারা দেশে গড়ে তোলা হচ্ছে হাজার হাজার বিপজ্জনক ও ঝূঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। একটি কারখানা নির্মাণ করতে রাজউক, স্থানীয় পৌরসভা অথবা ইউনিয়ন, ফায়ার সার্ভিস, কারখানা অধিদপ্তর প্রমুখের অনুমতি নিতে হয়। কারখানায় অতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করলে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের অনুমতিও নিতে হয়। কারখানার কার্যক্রম চলা অবস্থায় প্রতি বছর বা দুই-তিন বছর পর পর লাইসেন্স নবায়ন করতে হয় কারখানাকে। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের জীবনমান ও নিরাপত্তা ইস্যুতে নিয়মিত পরিদর্শনও করতে হয় এসব প্রতিষ্ঠানকে। তবে দায়িত্ব থাকলেও কোনো ডিপার্টমেন্টই কারখানার নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০১২ সালে আশুলিয়ার তাজরিন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকা্লে শতাধিক মৃত্যু, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের বিশ্বকে নাড়া দেয়া দুর্ঘটনায় ১১৩৬ জনের মৃত্যু, ২০১৬ সালে গাজীপুরের টাম্পাকো কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে এবং পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদামের আগুনে শতাধিক মৃত্যুর পর সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব অবহেলা উঠে এসেছে।

অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক মেজর অব: শাকিল নেওয়াজ বলেন, একটি কারখানা নির্মাণ করতে রাজউক, স্থানীয় পৌরসভা অথবা ইউনিয়ন পরিষদের অনুমোদন নিতে হয়। ভবনের কোনো স্থান থেকে ২৩ মিটারের মধ্যে সিঁড়ি থাকার নিয়ম রয়েছে। ভবনে কমপক্ষে চারটি এক্সিট পয়েন্ট (সিঁড়ি) থাকা প্রয়োজন। তবে কোনটিতে রয়েছে মাত্র দুটি বা একটি এক্সিট পয়েন্ট। থাকে না অগ্নিনির্বাপনের কোনো নিজস্ব ব্যবস্থা।

তিনি বলেন, যে স্থপতি ভবনের ডিজাইন করে, যে ডিজাইন পাস করেন, এই ডিজাইনের ওপর যে লাইসেন্স দেন, ডিজাইনের ওপর যে ইন্স্যুরেন্সের টাকা দেয়, এই ফালতু পরিকল্পনার ওপর যেসব ব্যাংক কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয় তারা সকলেই এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ