ঢাকা, শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১ জিলকদ ১৪৪৫

বাবরি মসজিদ রায় ও বিচারপতি গগৈ

প্রকাশনার সময়: ২০ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৪০

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ স্বীকার করেছেন, তিনি অযোধ্যা বিতর্ক মামলার রায় দেয়ার পরই নিজের প্রিয় মদ পান করেছিলেন! সম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে এসব কথা স্বীকার করেছেন। তিনি অনেক কথা লিখেছেন, তবে বেশি সমালোচনা হচ্ছে উপরের স্বীকারোক্তি নিয়ে। কতিপয় লোকের ধারণা, বিচারপতি গগৈ ঘোরতর স্পর্শকাতর যে রায় দিয়েছিলেন, এমন রায় দেয়ার পর স্বাভাবিক জ্ঞানে থাকা তার সুস্থতার জন্য ক্ষতিকর ছিল। এ জন্য তিনি মাতালান্তে বেহুঁশ হয়ে যাওয়াকেই সঠিক মনে করেছিলেন!

স্পষ্ট কথা, যে রায়ের মাধ্যমে অন্য ধর্মের অনুভূতিকে ধোঁকা দেয়া হয়, সে রায়ের পর মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি স্বাভাবিক থাকা সম্ভব নয়। আশ্চর্যের বিষয় হল, গগৈ এমন একটি তুমুল বিতর্কিত ও গুরুত্বপূর্ণ রায়ের ব্যাপারে আত্মগর্ব করে বলেছেন, ‘এই রায়ের মাধ্যমে পৃথিবীর নানা ধর্মীয় সংঘর্ষ ন্যায়সঙ্গতভাবে সমাধানের আশা সৃষ্টি হবে! রায়টি ইতিহাসে ‘বিচারিক ত্যাগের’ একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে!’

আমাদের জানা নেই, অযোধ্যা মামলার রায়ের মাধ্যমে পৃথিবীর ধর্মীয় সংঘাতের ‘ন্যায়সঙ্গত’ সমাধানের আশা কবে এবং কোথায় জন্ম নিয়েছে! হ্যাঁ, এতটুকু হয়েছে, তার রায়ে আন্দোলিত হয়ে উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির ঔদ্ধত্য আসমান ছুঁয়েছে! মসজিদকে মন্দিরে রূপান্তরের আন্দোলনে জোয়ার এসেছে! যা ভারতের শাস্তি-নিরাপত্তা ধ্বংসের সবচেয়ে বড় ঘণ্টি! এর তাজা উদাহরণ মথুরার শাহি ঈদগাহের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক শক্তির বর্তমান উত্তেজনা-তাণ্ডব।

আত্মজীবনীতে গগৈ লিখেছেন, ‘অযোধ্যা বিতর্ক সমাধানের পেছনে ‘রুহানি শক্তি’ কাজ করেছে!’ রায় শোনানোর পর তিনি নিজের বেঞ্চের বিচারপতিদের নিয়ে নয়াদিল্লির ‘তাজমান সিং হোটেলে’ যান, খানা-পিনা সমাপ্তের পর নিজেদের পছন্দের সবচেয়ে প্রিয় ও দামি মদ গলাধঃকরণ করেন!

জানা নেই, সেটা কোন ‘রুহানি শক্তি’ ছিল, যা তাদেরকে রায় দেয়ার পর মদ্যশালায় টেনে নিয়েছিল! মদপান ব্যক্তিগত বিষয়। বিচারপতি গগৈর ধর্মে মদপান নিষিদ্ধ নয়। অবশ্য ইসলাম মদপানকে সমস্ত নষ্টামির ‘মূল’ ঘোষণা করেছে। ফলে গগৈর মদপানে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে এ ব্যাপারে অবশ্যই আপত্তি আছে, তিনি ৫০০ বছরের প্রাচীন মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মাণের ফয়সালা নিজের পূর্ণ জ্ঞান-বুদ্ধির সঙ্গে দেয়ার পর, বুদ্ধি লোপ করাকে কেন জরুরি মনে করলেন?

বিশ্ববাসী জানে, অযোধ্যা মামলায় তার রায়টি ছিল অকাট্যভাবে সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতমূলক অন্যায় রায়। কারণ, তিনি নিজে বাবরি মসজিদ নির্যাতিত হওয়ার কথা স্বীকার করেও মন্দিরের পক্ষে রায় দিয়েছেন! এই রায়ের ফলেই ভারতের মুসলমানদের পরিচয় মুছে ফেলার স্বপ্নে বিভোর সাম্প্রদায়িক উগ্র গোষ্ঠী সারাদেশে তাণ্ডব শুরু করেছে।

আপনারা লক্ষ্য করেছেন, বিগত ৬ ডিসেম্বর যখন সারাদেশে ‘বাবরি মসজিদ শাহাদত দিবস’ পালন করা হচ্ছিল, সে সময়ই তাণ্ডবকারীরা মথুরার ঈদগাহে নিজেদের ‘খেলা’ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছিল। মথুরার ঈদগাহকে বাবরি মসজিদের মতো বিতর্কিত করতে এখানে মূর্তি স্থাপনের অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। তবে প্রশাসন-পুলিশ কঠোরভাবে সন্ত্রাসীদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, যারা মথুরার শান্তি-শৃঙ্খলা ধ্বংস করার চেষ্টা করছে, অন্য ধর্মের ইবাদতখানা অপবিত্র করছে, তাদের বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না?

এদিকে উত্তেজনায় ঘি ঢেলে উত্তরপ্রদেশের উপমূখ্যমন্ত্রী কেশব মারিয়া বলেছেন, ‘অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণ চলছে, এবার মথুরার পালা!’ অর্থাৎ মথুরার ঈদগাহে বাবরি মসজিদের মতই ব্যবস্থা নেয়া হবে! বক্তব্যটি এমন ব্যক্তির, যিনি আইনের শপথ পাঠ করেই উপমূখ্যমন্ত্রীর চেয়ার লাভ করেছেন!

স্মরণ থাকা উচিত, সুপ্রিম কোর্ট যে সময় বাবরি মসজিদের জমিকে ‘রাম জন্মভূমি ট্রাস্টকে’ অর্পণ করেছিল, তখন আরএসএসসহ অন্যান্য উগ্রবাদী সংগঠন আওয়াজ তুলেছিল, দেশে অযোধ্যার মতো আর কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হবে না। এসব বিষয় এখনই শেষ হওয়া উচিত! কিন্তু উগ্রবাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়, তারা মুখে যা বলে, কাজ করে তার ঠিক বিপরীত!

উপমূখ্যমন্ত্রী কেশবের পক্ষ থেকে মথুরার ঈদগাহের ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপন কোনো ‘হঠাৎ’ বিষয় নয়। এটা বিজেপির পরিকল্পিত কূটকৌশলের অংশ। এসব উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে তারা সামনের উত্তরপ্রদেশ এসেম্বলি নির্বাচনে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করতে চাচ্ছে। এ কারণেই কেশবের বক্তব্যের পর মথুরার ঈদগাহ সম্পর্কে রাজ্যসভার কয়েকজন বিজেপি সদস্য প্রশ্ন তুলেছেন।

স্পষ্ট কথা, ঐতিহাসিক মসজিদকে মন্দিরে রূপান্তর আন্দোলন মূলত ভারত থেকে মুসলমানদের পরিচয় বিলুপ্তির জন্যই শুরু করা হয়েছে। এই আন্দোলন শুধু মসজিদের নাম-নিশানা পরিবর্তন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং মুসলিম পরিচয়ই ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে। যোগি আদিত্যনাথের বড় সফলতা, তিনি নিজ রাজ্যের মুসলমানদেরকে ‘চতুর্থ শ্রেণির’ নাগরিকে পরিণত করতে চলেছেন! এমন অনেকগুলি শহরের নাম পরিবর্তন করে ফেলেছেন, যেগুলি মুসলিম নামেই প্রসিদ্ধ ছিল। আজমগড়, আলিগড় ও সুলতানপুরের মতো বিখ্যাত কিছু শহরের নাম পরিবর্তনের পথে! বিজেপি দেশের সর্বজনীন সংস্কৃতি ধ্বংস করে দেশকে পরিপূর্ণ হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার পথে জোরেসোরে হাঁটছে। ফলে মুসলিম পরিচয়ের ওপর বারবার আক্রমন হচ্ছে। কৃত্রিম বাহানা তুলে মুসলিম অস্তিত্ব নির্মূলের চক্রান্ত চলছে।

সন্ত্রাসীদের প্রধান টার্গেট ওই সব ঐতিহাসিক স্থাপনা, যেগুলো মুসলিম বাদশাহগণ স্থাপন করেছেন। সম্প্রতি দিল্লির একটি আদালত কুতুব মিনার সংলগ্ন মসজিদের ভেতর মূর্তি স্থাপনের আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। আবেদনে বলা হয়েছিল, সুলতান মুহাম্মদ ঘোরি ২৭টি মন্দির ধ্বংস করে ‘জৈন ও হিন্দু মন্দিরের’ জায়গায় কুতুব মিনার-মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন! তারা মসজিদের জায়গায় মূর্তি পুজার অধিকার দাবি করেন। আদালত এসব চক্রান্তমূলক আবেদন প্রত্যাখ্যান করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু উগ্রবাদীরা থেমে থাকবে না। মথুরার ঈদগাহ এবং বেনারসের জ্ঞানবাপি মসজিদের ওপর পূর্ব থেকেই সন্ত্রাসীদের লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে।

স্মরণ থাকা দরকার, ‘রাম জন্মভূমি মুক্তি আন্দোলনের’ সময় ভীতিজনক নানা স্লোগান জোরেসোরে শোনা যেত। এসব স্লোগানের একটাই উদ্দেশ্য, মুসলমানরা ভীত হয়ে বাবরি মসজিদের অধিকার থেকে হাত গুটিয়ে ফেলুক। কোনো-কোনো মুসলিম ‘পণ্ডিত’ তো বলেছিলেন, ‘বাবরি মসজিদ ছেড়ে দিয়ে অন্যান্য ইবাদতগৃহ রক্ষা করা যেতে পারে!’ চরম উত্তেজনাকর ওই সময়ও মুসলমানরা বলেছিলেন, ‘বাবরি মসজিদ শুধু একটি ইবাদতগৃহই নয়, বরং মুসলমানদের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যের একটি প্রতীকও। মুসলমানগণ বাবরি মসজিদের অধিকার ছেড়ে দিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের আরো বিতর্ক সৃষ্টি করা হবে।’

শুকরিয়ার বিষয়, মুসলমানরা হত্যা-খুন-গুম-ধর্ষণের শিকার হওয়া সত্ত্বেও বাবরি মসিজদের অধিকার হাতছাড়া করার সমস্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। বাবরি মসজিদ অবৈধভাবে দখল করতে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। বাবরি মসজিদ দখল করার পর সন্ত্রাসীরা এখন অন্যান্য মসজিদকে টার্গেট করছে। বিচারপতি গগৈর রায়ের সবচেয়ে বড় ভুল, তিনি মুসলিমবিদ্বেষী সন্ত্রাসী সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে একটি অস্ত্র তুলে দিয়েছেন।

‘জাদিদ খবরে’ প্রকাশিত প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিকের কলাম থেকে অনুবাদ

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ