ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

নারী অধিকার: পাশ্চাত্য বনাম ইসলাম

প্রকাশনার সময়: ১০ মার্চ ২০২৪, ০৮:৪০

আল্লাহ তায়ালা মানুষের মাধ্যমে পৃথিবী আবাদ করতে চান। পৃথিবীতে মানবজাতি একটা নির্দিষ্ট সময় বসবাস করুক, তাদের বংশবিস্তার ঘটুক-এটা মহান আল্লাহর ইচ্ছা। যেন মানুষ আল্লাহর ইবাদত করতে পারে এবং সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব কাজও করতে পারে।

বংশবিস্তারের প্রয়োজনে মহান আল্লাহ পৃথিবীর সব কিছু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। সব প্রাণীর মধ্যে যেমন নর-মাদী আছে, মানুষের মধ্যেও তেমন নারী-পুরুষ আছে। বিয়ের পবিত্র বন্ধনের মাধ্যমে দুজন নারী-পুরুষ একত্র হন। একটি পরিবার গড়ে ওঠে। তারপর বৈবাহিক সম্পর্ক ও সামাজিক প্রয়োজনে একটি পরিবারের সঙ্গে আরও পরিবারের সংযোগ ঘটে। এভাবে বহু পরিবার মিলে একটি সমাজ হয়, সমাজ থেকে জাতি হয়। রাষ্ট্র ও দেশ হয়।

পৃথিবীতে মানবজাতির টিকে থাকার জন্য পরিবারব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা টিকে থাকা অত্যন্ত জরুরি। কারণ মানুষ সামাজিক জীব। সে একা বাঁচতে পারে না। অন্যান্য প্রাণীর শাবকরা জন্মের পর খুব সামান্য সময় তাদের মায়ের সঙ্গে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই তারা নিজেরাই বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করতে পারে। এরপর প্রাণীদের মধ্যে আর পিতামাতা ও সন্তানের পরিচয় বলতে কিছুই থাকে না। কেউ কাউকে চেনেও না।

কিন্তু মানুষ অন্যান্য পশুদের মতো নয়। মানবশিশু পৃথিবীতে সবচেয়ে অসহায় হয়ে জন্মগ্রহণ করে। কয়েক বছর পর্যন্ত মায়ের যত্ন না পেলে সে বেঁচেই থাকতে পারবে না। এরপর স্বাবলম্বী হতে ও নিজের পায়ে দাঁড়াতে তার বহু বছর লেগে যায়। এই যে প্রাকৃতিক কারণেই মানবসন্তানের নিজের পায়ে দাঁড়াতে এতগুলো বছর লেগে যায়, এ সময়টুকুতে সন্তানকে কে সময় দেবে, কে আগলে রাখবে? প্রাকৃতিকভাবে সন্তান প্রতিপালনের সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নারীকে।

সন্তানের জন্মগ্রহণে পুরুষের কাজ শুধু ওই দাম্পত্য মিলনের সময়টুকুই। এরপর সেই সন্তানকে গর্ভে ধারণ, প্রসব করা, দুগ্ধদান করা, কোলেপিঠে করে মানুষ করা- এসব কাজ নারী একাই করেন। এগুলোর কোনোটাই পুরুষ করেন না। প্রাকৃতিক কারণে চাইলেও করতে পারবেন না। তাহলে পুরুষের কাজ কী? পুরুষের কাজ হলো, এই নারী ও সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণ করা। তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া, তাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা। নারী ও সন্তানের জীবিকা উপার্জন ও তাদের বেঁচে থাকার জন্য যা যা করা জরুরি, সব কিছুর ব্যবস্থা করা। এটাই হলো নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক কর্মবণ্টনের শাশ্বত ব্যবস্থা। ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম, তাই ইসলামও এ প্রাকৃতিক ব্যবস্থাই বহাল রেখেছে।

সন্তান গর্ভে ধারণ করা, দুগ্ধদান করা, প্রতিপালন করা, ঘরের কাজ করা, পরিবার সামলানো— প্রাকৃতিকভাবে এ কাজগুলো নারীকে দেয়া হয়েছে। আর পুরুষকে এসব কাজ থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে, যেন সে বাহিরের সব কাজ করতে পারে। পরিবারের জন্য জীবিকা উপার্জন করে, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করে। দেশরক্ষা, শাসন ও বিচার কাজ করে।

পুরুষের কাজগুলো যদি নারী করতে চায়, তাহলে নারী সে কাজগুলো পুরুষের মতো পুরোপুরি করতে না পারলেও কিছু না কিছু অবশ্যই পারবে। কিন্তু পৃথিবীর সমগ্র পুরুষ মিলেও একজন মা হতে পারবে না। সন্তান গর্ভে ধারণ করতে পারবে না। সন্তানকে দুধ দিতে পারবে না।

এখন যদি নারীকে বলা হয় যে, প্রাকৃতিকভাবে প্রদত্ত তোমার সব দায়িত্ব তুমি পালন করবে, পাশাপাশি পুরুষকে প্রাকৃতিকভাবে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে দায়িত্বগুলোও পালন করবে, তাহলে এটা কি নারীর প্রতি সুবিচার হবে? কখনোই না।

ইসলামে নারীর অধিকার

ইসলাম নারীকে অধিকার দেয়ার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রেখেছে।

প্রথমত, পারিবারিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুরুষকে অভিভাবকত্ব দেয়া হয়েছে। সন্তান ও স্ত্রীর জন্য পরিবারের অভিভাবকের আনুগত্য ফরজ করা হয়েছে। পাশাপাশি এ অভিভাবকত্বের সুযোগে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অভিভাবকের সম্পর্ক যেন মনিব-গোলামের মতো না হয়, সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, নারী যেন ইসলামি সমাজব্যবস্থা ও পরিবারব্যবস্থার মধ্যে থেকেও নিজের যোগ্যতা ও প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে, দেশ ও জাতির জন্য অবদান রাখতে পারে, সেই সুযোগ রাখা হয়েছে।

তৃতীয়ত, নারী যেন আপন কাজের ক্ষেত্রে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারে, নারী হওয়ার কারণে পিছিয়ে না থাকে, সেটা নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে সেটা নারী হিসেবে করতে হবে। নারী থেকেই করতে হবে। পুরুষ হয়ে কিংবা পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নারীকে সফল হতে বলা হয়নি।

এসব বিষয়কে সামনে রেখে নারীকে অর্থনৈতিক অধিকার দেয়া হয়েছে। দেশ ও জাতি গঠনে অবদান রাখার অধিকার দেয়া হয়েছে। সম্মান ও মর্যাদার উচ্চতম আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। এসব অধিকার ও মর্যাদা সংরক্ষণের জন্য নৈতিক ও আইনগত নির্দেশাবলি দ্বারা যে ধরনের চিরস্থায়ী গ্যারান্টি দান করা হয়েছে, তার নজির পৃথিবীর প্রাচীন বা আধুনিক কোনো সমাজব্যবস্থায় নেই।

নারীর অর্থনৈতিক অধিকার

নারীদের দুর্গতির অন্যতম প্রধান কারণ তার অর্থনৈতিক দুর্বলতা। ইসলাম ব্যতীত পৃথিবীর সব সমাজব্যবস্থার আইন-কানুন নারীকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে রেখেছে। ইউরোপ-আমেরিকার লোকেরা নারীর এ সমস্যা দূর করার জন্য নারীকে চাকরিতে নিয়োজিত করেছে। ফলে পুরুষের মতো কাজ করতে গিয়ে নারী তার নারীত্ব ও মাতৃত্ব হারিয়েছে। ইসলাম এ দুই অবস্থার মাঝামাঝি মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেছে। আইনের মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক ভিত মজবুত করেছে। আবার নারীকে ঘরের বাইরে চাকরিও করতে বলেনি।

ইসলাম বলেছে, নারী স্বামীর মোহরানা পাবে। পিতা, স্বামী, সন্তান ও অন্যান্য নিকটাত্মীয়ের উত্তরাধিকার সম্পদ পাবে। নিজের সম্পদ বিনিয়োগ করে কিংবা পরিশ্রম করে উপার্জন করতে পারবে। এভাবে সে যত সম্পদের মালিক হবে, সেটার সম্পূর্ণ মালিকানা ও ব্যয়ের অধিকার নারীর নিজের থাকবে। এতে স্বামী, পিতা, ভাই বা অন্য কেউ কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। পাশাপাশি নারী যত সম্পদেরই মালিক হোক না কেন, নারীর ভরণপোষণের সব দায়িত্ব স্বামী বহন করতে বাধ্য থাকবে।

সামাজিক জীবনে নারীর অধিকার

১. স্বামী নির্বাচনের পূর্ণ অধিকার। নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে কেউ পাত্রস্থ করার অধিকার রাখে না। অবশ্য নারী যদি এমন হীণ কাউকে নির্বাচন করে, যে তার বংশের তুলনায় নিকৃষ্ট তাহলে অভিভাবকদের আপত্তির অধিকার থাকে।

২. একজন অত্যাচারী, অকর্মণ্য বা অ-মনঃপূত স্বামী থেকে বিচ্ছেদ গ্রহণের পূর্ণ অধিকার নারীর রয়েছে।

৩. স্ত্রীর ওপর স্বামীকে যেসব অধিকার দেয়া হয়েছে, সেগুলো সদাচার ও দয়াদ্র ব্যবহারের সঙ্গে প্রয়োগ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোরআন বলে, ‘তোমরা তোমাদের নারীদের সঙ্গে সদাচরণ কর।’

পারস্পরিক সম্পর্ককে দয়াদ্র ও স্নেহশীল করতে ভুলো না। প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম যে তার পরিবারের নিকট উত্তম। আমি আমার পরিবারের নিকট উত্তম।’

এগুলো শুধুমাত্র নৈতিক উপদেশ নয়। যদি স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর ওপর অধিকার প্রয়োগে অন্যায় করা হয়, তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার স্ত্রী সংরক্ষণ করবে।

৪. কোনো কারণে নারী পূর্ব স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হলে, তার পরবর্তী বিয়ে করার পূর্ণ অধিকার থাকবে। এ বিষয়ে পূর্ব স্বামী কিংবা আত্মীয়স্বজনের বাধা প্রদান করার কোনো এখতিয়ার নেই।

৫. দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে নারী-পুরুষ সমান। জীবন, সম্পদ ও ইজ্জতের নিরাপত্তার ব্যাপারে ইসলামে নারী-পুরুষে কোনো পার্থক্য রাখা হয়নি।

নারীর শিক্ষার অধিকার

দ্বীনি ও পার্থিব শিক্ষা লাভ করার ক্ষেত্রে নারীকে শুধু অনুমতিই দেয়া হয়নি, বরং নারীর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পুরুষের জন্য যেমন জ্ঞানার্জন করা ফরজ, নারীর জন্যও ফরজ। প্রিয়নবী (সা.) থেকে পুরুষগণ যেমন শিক্ষা লাভ করত, নারীগণও তেমন শিক্ষা লাভ করত। নারীদের জন্য পৃথক সময় নির্ধারিত ছিল। প্রিয়নবী (সা.)-এর সহধর্মিণীগণ বিশেষত আম্মাজান আয়েশা (রা.) শুধু নারীদের শিক্ষক ছিলেন না, পুরুষদেরও শিক্ষক ছিলেন। বড় বড় সাহাবি ও তাবেয়িগণ তাদের নিকট থেকে তাফসীর, হাদিস, ফিকহ ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা লাভ করতেন।

অতএব, মৌলিক শিক্ষায় নারী-পুরুষে কোনো পার্থক্য নেই। তবে শিক্ষার ধরনে নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর প্রকৃত শিক্ষা হলো—

১. যে শিক্ষা তাকে উৎকৃষ্ট মা, উৎকৃষ্ট স্ত্রী ও উৎকৃষ্ট গৃহিণীরূপে গড়ে তোলে।

২. যে শিক্ষা তাকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলে। চরিত্র গঠন করে। দৃষ্টিভঙ্গি প্রশস্ত করে।

৩. এগুলো শেখার পর নারী অসাধারণ প্রজ্ঞা ও মানসিক যোগ্যতার অধিকারী হলে অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানেও উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তাতে শরিয়তের সীমালঙ্ঘন না হয়।

ইসলামে সম্ভ্রান্ত নারীদেরকে তো বটেই, দাসীদেরকে পর্যন্ত শিক্ষা দিতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, ‘যার নিকট কোনো দাসী আছে, সে যদি তাকে ভদ্রতা ও শালীনতা শিক্ষা দেয়, বিদ্যা শিক্ষা দেয়, এরপর তাকে আজাদ করে বিয়ে করে, তাহলে তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ পুণ্য।’

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ