ঢাকা, শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
বই দিবস

আসুন বইপ্রেমী হই

প্রকাশনার সময়: ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ২০:৫২ | আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ২১:৪৯

২০২২ সালের জুনে ফিনল্যান্ডের হ্যালসিনকি এয়ারপোর্ট থেকে প্যারিসের ফ্লাইট ধরার জন্য দৌড়াচ্ছি। এটা বিশ্বের অন্যতম সেরা সেবাদানকারী একটি এয়ারপোর্ট। ফ্লাইটের তথ্য খুঁজে নেওয়া, চেক ইন করা, ব্যাগেজ/লাগেজে ট্যাগ লাগিয়ে হ্যাংয়ারে দেওয়া, বোর্ডিং পাস নেওয়াসহ প্রায় সব কাজই যাত্রীদের নিজেই করতে হয়। বাইরের তাপমাত্রা তখন মাইনাস-৬। বোর্ডিংয়ে যাওয়ার সময় নেই। কারণ আমাদের কোপেহেগেনের ফ্লাইটটা ছিল প্রায় দেড় ঘন্টা বিলম্বে। আমাদের সফর সঙ্গী একজন ফ্রেন্স মহিলা। ঠিক সঙ্গী নয়। সাময়িক পরিচয়। পেশার চিকিৎসক। বয়স ৩৫-৪০ এর ঘরে হবে। যদিও মেয়েদের বয়স অনুমান করাটা খুবই দুরুহ। আমি এটা মোটেও পারি না।

যাক গে, মূল কথায় ফিরে আসি-মেয়েটির পিঠে বড়সড় ব্যাগেজ। দুই হাতেই লাগেজ। কাঁধে আরো একটি ব্যাগ। হাতে আরও আছে পিলো, পানির পট, শপিং ব্যাগ, মোবাইল ফোন ইত্যাদি। কোমরে বেঁধে রেখেছেন ওভারকোট। আমাদের সাথে তিনিও দৌঁড়াচ্ছেন এবং হাঁপাচ্ছেন। হঠাৎ খেয়াল করলাম মেয়েটির বাম হাতে একটি পুরনো বই। বইয়ের পৃষ্ঠা খোলা। যদিও সেটা আগের ফ্লাইটে আমার চোখে পড়েনি। কারণ দুজেনর সিটের দূরত্ব ছিল বেশ অনেক। হ্যাস্তন্যাস্ত হয়ে সারিতে দাঁড়ালাম। মেয়েটি আমাদের পেছনেই কিন্তু শেষদিকে। আমি এখনও হাঁপাচ্ছি। মেয়েটাও হাঁপাচ্ছে। দূর থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সোয়েটারটা টাইট হওয়ার কারণে দেখা যাচ্ছে, তার বুক দ্রুত উঠানামা করছে। এরপরও সুযোগ পেলেই বইয়ের পাতায় চোখ বুলাচ্ছেন।

অবশ্য ইউরোপ-আমেরিকার প্রায় সব দেশের মেট্রো স্টেশন, বিমান বন্দর কিংবা বাস স্ট্যান্ডে এমন দৃশ্য অহরহই চোখে পড়ে। তবে ফ্রান্স, রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডে বোধ হয় এমনটা বেশিই দেখা যায়।

প্যারিসের শেইন নদীর পাড়ে যে ন্যাশনাল লাইব্রেরী অব ফ্রান্স রয়েছে। সেই লাইব্রেরীর ভবনগুলোর আকৃতি একেবারেই বইয়ে ধাঁচে গড়া। সামনে থেকে তাকালে মনে হবে খোলা বই। পেছন থেকে তাকালেও মনে হবে খোলা বই। সুউচ্চ ভবনের জানালাগুলোও বইয়ের আকৃতিতে গড়া।

ইংল্যান্ডের স্ট্র্যাটফোর্ড-আপঅন-অ্যাভনে (নদী) জন শেকসপিয়রের বাড়ি। এটিকে শেকসপিয়রের জন্মস্থল মনে করা হয়। শেক্সপিয়ারের বাড়ির চত্বর থেকে একটু দূরে বাগানের ভেতরে একটি থিয়েটার রয়েছে। যেখানে শেকসপিয়ার নিজে পারফর্ম করতেন। তাঁর লেখা নাটক এখানে মঞ্চস্থ হতো। সেই থিয়েটারের ভেতরে শত শত বছরের পুরনো বইপত্র রয়েছে। এখন নাটক মঞ্চস্থ হয় এখানে।

বিখ্যাত রম্য ও ভ্রমণ লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, ‘বই কিনে কেউ কখনও দেউলিয়া হয় না’। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই বই এবং বই’। মার্ক টোয়েন বলেছেন, ‘ভাল বন্ধু, ভাল বই, এবং একটি শান্ত বিবেক: একটি আদর্শ জীবন’। রবী ঠাকুর বলেছেন, ‘বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেওয়া সাঁকো’। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘আনন্দের জন্য পঠন’। অর্থাৎ যা পড়বেন আনন্দের সহিত পড়বেন।

আমি বলি-‘যদি এই নশ্বর পৃথিবীতে অবিনশ্বর হতে চাও; তবে পড়, পড় পড় এবং লিখ। প্রতিদিন কিছু না কিছু লিখ’। বই মানুষকে শেখায়। যদিও এটি একটি জড়বস্তু। তবে আমি বলি, বই জীবন্ত। বই কখনও মরে না। বইকে পড়তে হয়, মগজ দিয়ে চিবাতে হয়। পড়ে পড়ে জীবিত রাখতে হয়। যে বই পড়া হয় না, সেটা অবশ্যই মৃত। আর যে বই পড়া হয় সেটা কখনও মরে না।

আজ বিশ্ব বই দিবস। বই হচ্ছে লিখিত বা চিত্রাকারে তথ্য সংরক্ষণের একটি মাধ্যম। যা সাধারণত প্যাপিরাস, পার্চমেন্ট বা কাগজের অনেকগুলো পৃষ্ঠা একত্রে বাঁধাই করে তৈরি করা হয় এবং একটি প্রচ্ছদ দিয়ে সুরক্ষিত থাকে। বই বিভিন্ন আকৃতিতে বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনে তৈরি করা হয়। বই এমন একটি মাধ্যম, যা যেকোনো দেশের যেকোনো ভাষাভাষী মানুষের ব্যবহারের জন্য সমাদৃত। নিজ নিজ মাতৃভাষায় লিখিত রূপের অর্থবহ লেখা বই। মানুষেকে সমাজবদ্ধ জীবনের যাপিত জীবন ব্যবস্থার উৎকর্ষ অবস্থায় পৌঁছে দিতে পারে বই।

প্রথম বিশ্ব বই দিবস ১৯৯৫ সালের ২৩ এপ্রিল পালিত হয়েছিল এবং সেই দিনটিকে স্বীকৃত করা হয়। যুক্তরাজ্য এবং আয়ারল্যান্ডে একটি সম্পর্কিত ঘটনা মার্চ মাসে পালন করা হয়। বিশ্ব বই ও কপিরাইট দিবস উপলক্ষে ইউনেস্কো বই শিল্পের প্রধান খাত থেকে উপদেষ্টা কমিটির সাথে এক বছরের জন্য বিশ্ব বইয়ের রাজধানী নির্বাচন করে। প্রতিটি মনোনীত ওয়ার্ল্ড বুক ক্যাপিটাল সিটি বই এবং পাঠ উদযাপন এবং প্রচারের জন্য কার্যক্রমের একটি কর্মসূচি পালন করে।

খুব সম্ভবত জাতি হিসেবে বাঙালি জাতি বই থেকে সরে যাচ্ছে প্রতি মুহুর্তে। বই পড়ার অভ্যাস আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তরুণ সমাজ। স্যোসাল মিডিয়ায় বুঁদ হয়ে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, রাতের পর রাত। না ঘুমিয়ে জেগে থাকছে স্যোসাল মিডিয়ার নেশায়।

ঠাকুরগাঁওয়ে আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে শহরের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। ছোটবেলায় বাইসাইকেল চালিয়ে জেলা গণগ্রন্থাগারে যেতাম বই এবং পত্রিকা পড়তে। তখন দিনের পত্রিকা দিনে পাওয়া যেত না আমাদের এলাকায়। আপনাদের মনে থাকার কথা, পলান সরকার বা জিয়াউল হকের কথা। যারা বইয়ের ফেরি জীবনটাকেই বিলিয়ে দিয়েছেন সমাজের তরে। বইপ্রেমী মানুষের তরে। বই বিলিয়ে দুজনেই পেয়েছেন একুশে পদক।

পরিশেষে এই বলি, আসুন বই পড়ি। বই লিখি। বই উপহার দেই। বই কিনি। বই সংরক্ষণ করি।

লেখক- মানিক মুনতাসির

নয়া শতাব্দী/টিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ