ঢাকা, সোমবার, ৩ জুন ২০২৪, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২৫ জিলকদ ১৪৪৫

দূর লুকিয়ে

প্রকাশনার সময়: ৩১ জুলাই ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২১, ০৪:০১

এ পৃথিবীতে একটা ঘর ছিল। মাটির ওপরে মাটি দিয়ে গড়া। মাটির ঘর। ঘরের চালে রোদের ছায়া পড়ত সব সময়। বৃষ্টিও পড়ত। তুমুল বর্ষায় জল গড়িয়ে পড়ত ফুটো দিয়ে। কুমড়ো শাখার ডগা গলে টুপুর-টাপুর শব্দ আসত। ঘরের মেঝেটা পানিতে ধুয়ে-মুছে থ্যাকথ্যাকে হয়ে থাকত। গোবর লেপা আঁচড় গলে মাটির সানকির গোলগোলে ছাপ জন্মাত। আমার জন্ম এমনই একটা ঘরে। সারাক্ষণই সে ঘর ধোঁয়া হয়ে থাকত। বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ মিশে সেখানে একটা ভ্যাঁপসা আর পোড়া গন্ধ জন্ম নিত। অন্তত জন্মের প্রথম শ্বাসে এমনই গন্ধ পেয়েছিলাম এ আমি হলফ করে বলতে পারি।

কোথায় এসেছি জানি না। তাকে কি ঘর বলে নাকি ঘরের ভেতর পৃথিবী সে সম্বন্ধেও কোনো সুবিচার করা যাচ্ছিল না! তবে পাশে এক কোমল হাতের স্পর্শে বারবার যেন কেঁপে যাচ্ছিলাম। কোনো অজ্ঞাত মহিলার তীব্রধারী বীর্য চেপে আমার আগমন যাকে আমি পরে মা বলতে শিখেছি তার কথা ভুলব কি করে। মা তখন সন্তান জন্ম দেয়ার মতো প্রথম বেদনায় কুঁকড়ে পড়েছিলেন। হাবভাবে যেন সব যন্ত্রণার অবসান ঘটে গিয়েছে। এখন শুধু আমার চেহারা দেখলে মুক্তি পান। ফোঁসফোঁস শব্দ করে নিঃশ্বাস টানছিলেন। খুব কষ্ট হয়ে গিয়েছে আমাকে জন্ম দিতে। আমি যেন সে যন্ত্রণার কুক্ষিগত ফল। আগলে ধরে বারবার পাছার তলের কাপড় উল্টেপাল্টে দেখছিলেন মেয়ের কষ্ট হলো কিনা।

আমি সেই জন্মান্তরের একচ্ছত্র অধিপতির মতো সোল্লাসে আমার বিজিত ভঙ্গি চেপে রাখতে জোর সোল্লাসে চিৎকার করে উঠছিলাম। আর আমার অবুঝ মা তাকে ভীষণ কান্না ভেবে ভয়ার্ত চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন। কেউ শুনে ফেলবার ভয় ছিল তার। হয়তো তারা বলত এ তুমি কেমন মাগো। বাচ্চার সামান্য কান্নাটুকু থামিয়ে রাখতে পারলে না। তারা কি জানত এ বজ্জাত (!) আমি কতটা আনন্দের ঘনঘটায় ভাসছিলাম তখন। জন্ম নেয়ার আনন্দ উদযাপন করতে তারা বোধ হয় আগে কাউকে দেখেনি। না হয় এভাবে বলতে পারত না। আমাকে দেখতে যারাই আসছিল তাদের প্রত্যেকের চেহারাই আমি তাদের আমৃত স্মরণ রেখেছিলাম। সে যে দক্ষিণপাড়ার পুরবী খালাটা। শ্বেতী রোগীর মতন করে ফর্সা আর লম্বাটাও ছিল না। আমার বাম গালটাতে আলতো করে টোকা দিয়ে দেখল সেখানে রক্ত জমে কিনা। সাদা চামড়া ভেদ করে সেখানে লাল রঙের জন্ম হয় কিনা। আমি তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম। কাঁদিনি। কাঁদব বা কেন। সবেই তো পৃথিবীটাকে বুঝে-সুঝে চালু করে নিচ্ছিলাম। এখনই দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে গেলে তারা তো প্রথমেই আমাকে ধরে ফেলবে। পরে মাথা উঁচু করে ঠিক করে দাঁড়াতেও পারব না।

পরে আমার জীবনে দেখা অন্যতম সুন্দর রমণীদের একজন এই পুরবী খালাকে যখন শ্মশানঘাটে পোড়াতে নিয়ে গেল আমি পথ দেখাবার মতো তিড়িংবিড়িং দৌড়ে সবার আগে ছুটছিলাম । আমাকে যেন তার মান রাখতে হচ্ছিল। চন্দনের পোড়ো কাঠের সঙ্গে যখন ঘি-এর পোড়া গন্ধ নাকে এলো আমি যেন আবার আমার জন্মের সময়টায় ফিরে গেলাম। অবিকল এক গন্ধ। এ কি করে সম্ভব। ঠিক তখন আমার গাল বেয়ে দুই ফোঁটা কান্না গলিয়ে পড়ছিল। আমি যে কত ভালোবাসার হাড়ে হাড়ে যেন তার জল শুকাচ্ছিল। শবদেহের করোটি ফাটার শব্দবাদে ও দিনের আমার আর কিছু মনে করবার ছিল না। ফের আসি জন্মক্ষণে। বাবা তখন কাছে ছিলেন না। কি যেন জরুরি কাজে তার অন্য জায়গায় থাকতে হয়। তিনি জানলেও আসতেন না। কাজের প্রতি আর মানুষদের সহযোগিতার প্রতি তার ছিল অগাধ আস্থা। অবিচল থাকতেন যেন কোথাও ভুল একটি না হয়। তার একমাত্র মেয়েকে তিনি দেখতে এলেন ঠিক ১৫ দিনের মাথায়। সেদিন আমাদের পাড়াতে জোরে ঝড় উঠেছিল। আমাদের দোতলার সিঁড়ির কোনার ঘরটাতে আমি একলা শুয়েছিলাম। ছাদ থেকে মা, ফুপু, খালাদের ধুপধাপ পায়ের শব্দ কানে আসছিল। আমার ছোট ছোট কাপড়গুলো কি এই বাতাসে আর আস্ত আছে! যাই হোক একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল সঙ্গে সঙ্গে।

দূরে কোথায় একটা বাজ পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম আর আমাদের ঘড়ঘড়া কাঠের দরজায় মৃদু করাঘাত। এ দরজার ছোট একটা বর্ণনা দিয়ে রাখা ভালো। ওই যে শ্বেতী রোগীর মতো পুরবী খালার কথা বলেছিলাম। এ দরজাটা যেন তার রঙে মিল রেখে করা। এমন ধবধবে সাদা ছিল যে, আমি যখন বাড়ির সামনের ঘাটলায় রাতবিরাতে একা একা গিয়ে বসতাম পিছে ফিরলে ভীষণ ভয় লাগত। একটা কৃষ্ণগহবরের সামনে যেন একচিলতে রোদ কেউ ফাঁকি দিয়ে রেখে গেছে। সেখান হতে সাদা আলোয় যেমন রাত্রি জ্বলত এমন করে আমি আর কোথাও দেখিনি। কি জাতের কাঁঠে এমন ধবধবে ফর্সা রং মেলে তা আজ অবধি নিরুদ্দিষ্ট। সে দরজায় করাঘাতের শব্দ আমার মুখস্থ। কিন্তু আজ যেন সেখানে ভিন্ন সুর। কে যেন আলতো ভাবে আঁচড়াচ্ছে। বিড়াল যেমন শব্দহীনভাবে হাঁটতে গিয়ে পাকা মেঝের ওপর পড়ে থপথপ শব্দ করে ঠিক যেন ওরকম। তার সঙ্গে বাতাসের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ মিলে আমার শরীরটাতেই যেন কেউ টোকা দিয়ে যাচ্ছে।

আমি আবার মনোযোগ দিয়ে কান পাতলাম। টুকটুক পায়ে গমগমে ভারী কণ্ঠ কানে এলো। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হালকা পায়ের খসখসে আওয়াজ। শব্দের এমন অদ্ভুত সংগতি আমি প্রথম শুনলাম। সিঁড়ির গা থেকে একটা বোটকা কেরোসিনের বাতাস এসে ঘরটাকে আরো ঝাপসা করে দিল। সে ঝাপসা আলো গলে কান পেতে শব্দটাকে জোরালো হতে শুনলাম। ঠিক আমার

বিছানার কাছে এসে থামল। আমি চোখ দুটো টিপ মেরে দম বন্ধ করে শুয়ে আছি। একটা মুখের ছায়া আমার ওপর এসে পড়তেই যেন চকিতে আমি বুঝে নিলাম এ আর কেউ নয়। স্বয়ং আমার পিতাশ্রী। যার অপেক্ষাতে পনেরোটা দিন আমার মা ঠিক করে খাওয়া-দাওয়া করতে পারত না, সবসময় চেহারাকে একটা ভীষণ ভাব রেখে কথা বলতেন সে আর কেউ নয় ইনার জন্যে। আমি কতক্ষণ সময় নিয়ে চোখ খুললাম জানি না, কয়েকশ’ (!) বছর তো হবেই খুলে দেখি একটা সুন্দর মুখ চোখ কাঁচুমাচু করে ড্যাবড্যাব করে আমার মুখপানে চেয়ে রইছে। যেন কি মস্ত অপরাধ করে এসেছে তার ফিরিস্তি দিতে চান তিনি তার মেয়ের কাছে। আমি কিছু না বুঝেই ভ্যা ভ্যা করে দিলে ভেজা চোখে এবার দেখলাম তার মুখে ক্লান্তি নেমে এসেছে। তিনি বার কয়েক ভেবে যেন আমাকে কোলে তুলে নিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে কান্না থামিয়ে দিলাম। এই প্রথমবারের মতো তার মুখে হাসি ফুটতে দেখা গেল। আর তারই সঙ্গে বুঝলাম এমন প্রাণখোলা হাসি আমার বাবাই কেবল হাসতে পারেন। কাছেই আর একবার বাজ পড়ার শব্দ হলো। বাবা আমাকে তার বাড়ি দেখাতে নিতে বেরুলেন। আমি শক্ত করে তার বুড়ো আঙ্গুল চেপে বসি তাকে দেখছি। কি প্রগাঢ় নিভৃতায় তিনি আমার দেহের প্রান্তগুলোকে আস্ত রাখতে জোর প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন। যেন এতদিনের আদরের অভাবটুকু এক সন্ধ্যাতে পুষিয়ে দিতে চাইছেন। এমন একটা ব্যাপার। মা এসে তার কোলে নিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত বাবার সঙ্গের পুরো সময়টুকুর স্মৃতিটা এখনো জ্বলজ্বল হয়ে ভাসে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ