ঢাকা, শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৯ জিলকদ ১৪৪৫

চোখবাঁধা মাইক্রোবাস ও শূন্যতার গল্প

প্রকাশনার সময়: ১৯ ডিসেম্বর ২০২১, ২২:২৯ | আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২২, ১৭:১১

পৌষের দিন। রায়েরবাজারের শেষ মাথায় বিল। বিলের ভেতরে অনেক ডোবা। ডোবায় ভাসছে কচুরিপানা। ফুটে আছে বেগুনি চোখওয়ালা ফুল। কত কত ফুল ফুটে আছে! চোখ জুড়ানো, মন ভোলানো ফুল। তারই কোলে ভাসছে লাশ। কারো হাতের আঙুল নেই, কারো পায়ের। কারো হূৎপিন্ড তুলে নেয়া হয়েছে, কারো বা গায়ের চামড়া ছিলে ফেলা। কোনো লাশ বিচ্ছিন্ন, কোনো লাশ স্তূপাকৃত। আহ্! বাংলার বুদ্ধিজীবীদের লাশ ভাসছে ডোবায়।

এভাবেই একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরে বর্বরোচিত বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা-প্রবাহে এগিয়েছে নাটক ‘চোখবাঁধা মাইক্রোবাস ও শূন্যতার গল্প’। গত শনিবার রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে মঞ্চায়িত হয় নাটকটি। ব্যবস্থাপনায় ছিল ঢাকা জেলা শিল্পকলা একাডেমি এবং সহযোগিতায় ঢাকা জেলা প্রশাসন।

মূলত রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে সংঘটিত একাত্তরের গণহত্যাকে কেন্দ্র করে নাটকটি রচিত। নাটকে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের কর্ম দেখানো হয়েছে। দেখানো হয়েছে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি পাকিস্তানিদের ক্ষোভ, রাজাকার-আলবদরদের সহায়তায় তাদের আটক ও অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের হত্যা করার চিত্র।

নাটকে দেখানো হয়েছে, বুদ্ধিজীবীদের কর্মযজ্ঞ। যা দেখলে বোঝা যায়, তারা কী প্রচণ্ড দেশপ্রেমী ছিলেন। বাঙালিসত্তাকে বাঁচানোর জন্য নিজ নিজ স্থানে নিজেদের কাজগুলো করে গেছেন নিষ্ঠা এবং একাগ্রতায়। বুদ্ধিজীবীরা যে শুধু নিজেদের কর্মক্ষেত্রের কাজ করে দেশকে জাগিয়ে রেখেছিলেন তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতাও করেছিলেন।

নাটকে আরো দেখানো হয়, পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র এবং নীল নকশার কথা, রাওফরমান আলী-টিক্কা খানের পিশাচী কর্মকাণ্ড, রাজাকার-আলবদরদের বিভিন্ন কার্যক্রম। এছাড়া ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যাসহ ঢাকা শহরের অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড উঠে এসেছে এই নাটকে, এসেছে প্রতিরোধ ও গেরিলাদের বিভিন্ন আক্রমণের কথা।

নাটকটি শেষ হয়েছে একাত্তরের ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজারে বুদ্ধিজীবীদের মরদেহ খুঁজে পাওয়ার মধ্য দিয়ে। সেদিন যাদের মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল, তারা যেমন নাটকে আছেন, যাদের মরদেহ কোথাও পাওয়া যায়নি তারাও নাটকে রয়েছেন।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নাটকটি রচনা করেছেন ড. মাহফুজা হিলালী। নির্দেশনা দিয়েছেন আমিনুর রহমান মুকুল।

নাটকটির রচয়িতা ড. মাহফুজা হিলালী বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল এ কথা সবাই জানেন, কিন্তু অনেকেই জানেন না বাঙালি জাতিসত্তাকে বিশ্বের বুকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে তারা কী কী করেছিলেন। বাংলা ভাষা রক্ষা এবং বাংলাদেশ গঠনে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সচেতন প্রয়াসের কথাও জানেন না অনেকে। মুক্তিযুদ্ধ, বুদ্ধিজীবী, গণহত্যা, স্বাধীনতা এই শব্দগুলো এখন সর্বত্র প্রবাহিত হচ্ছে, কিন্তু এর ‘গভীরতা’ কতটুকু তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে না নতুন প্রজন্ম এবং সাধারণের কাছে। যে কারণে দেশপ্রেম এবং মূল্যবোধের শেকড় থেকে ছিটকে পড়ছে মানুষ। চোখবাঁধা মাইক্রোবাস এবং শূন্যতার গল্প নাটকে দেশপ্রেম এবং মূল্যবোধের সু-গভীর তল ও মূল শেকড় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।’

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে বেশকিছু কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। এসব কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য, মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির বীর সন্তানদের যে ত্যাগ তার মহিমাকে নতুন প্রজন্মের সামনে বিভিন্ন প্রযোজনার মাধ্যমে তুলে ধরা এবং বাঙালি জাতির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে শিল্পের আলোয় নতুনভাবে পাঠ ও সংরক্ষণসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উপস্থাপনের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষে ভূমিকা পালন করা।’

তিনি আরো বলেন, ‘সুবর্ণবর্ষে একাডেমির একটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি ৬৪ জেলায় ৬৫টি বধ্যভূমিতে গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটার নির্মাণ। ইতোমধ্যে বধ্যভূমি নির্বাচন, গবেষণা কার্যক্রম, পাণ্ডুলিপি তৈরি ও মহড়া কার্যক্রম শেষে জেলা শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ থিয়েটার মঞ্চায়নের পথে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে এ কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা আশাবাদী।’

নাটকে নির্দেশকের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন সেলিম হায়দার ও কামরুজ্জামান তাপু। সেট নির্মাণে আলি আহমেদ মুকুল, কোরিওগ্রাফিতে অনিকেত পাল এবং আবহ সংগীত করেছেন অজয় দাশ। নাটকে অভিনয় করেছেন ক্যাম্পাস থিয়েটার আন্দোলন, বাংলাদেশ ও বাঙলা কলেজ যুব থিয়েটারের নাট্যকর্মীসহ বিভিন্ন থিয়েটারের শতাধিক শিল্পী ও কলাকুশলী।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ