ঢাকা, বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৬ জিলকদ ১৪৪৫

পায়ে লিখে এসএসসি পরীক্ষা 

প্রকাশনার সময়: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৭:৪৬

জন্মের পর থেকেই একটি হাত নেই সিয়াম মিয়ার। আরেকটি হাত অস্বাভাবিকাভাবেই ছোট। দুই হাতের শক্তি ছাড়াই বেড়ে ওঠে সিয়ামের জীবন। লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছা শক্তির কাছে হার মানে তার প্রতিবন্ধকতা। দুই হাত না থাকায় পা দিয়ে শুরু করেন লেখার কাজ। একে একে পিএসসি, জেএসসির পর এখন বাম পা দিয়ে লিখে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে সিয়াম।

২০০৬ সালের ২৯ জানুয়ারি জামালপুরের সরিষাবাড়ির উদানপাড়া গ্রামে জিন্নাহ-জোৎস্না দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করে সিয়াম মিয়া। প্রথম দিকে বার বার হোঁচট খেলেও বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় সিয়াম পেয়েছে মনোবল। ফিরেছে আপন শক্তিতে। লেখাপড়া শেষে বড় সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার আশা সিয়ামের।

কিশোর সিয়াম মিয়া বলে, আমার হাত না থাকায় অনেকে অনেক কথা বলেছে। অনেকে বলেছে আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। আবার অনেকে বলেছে আমার ভবিষ্যৎ ভালো। অনেক কথার মাঝে আমি বড় হয়েছি। এখন শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আমার সমস্যা হয় না। এখন আমি উদ্যমী। এখন আমি শুধু এগিয়ে যাব।

সিয়াম আরও বলে, সব সময় মনে করেছি যে, আমি এগিয়ে যেতে পারব না। পা দিয়ে লিখতে গিয়ে অনেকবার ব্যর্থ হয়েছি। অনেকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে লেখাপড়া ছেড়ে দেব। আমার বন্ধুরা আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। তারা আমাকে অনেক সহায়তা করেছে। তাদের জন্য আমি আজ পা দিয়ে লিখতে পারি। এখন লিখতে তেমন অসুবিধা হয় না। আগে অনেক কষ্ট হতো। পা অনেক ব্যথা করত।

বড় হয়ে সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্নের কথা জানিয়ে সিয়াম বলে, আমার দরিদ্র পরিবারের অভাব দূর করব। আমার বাবা-মা অনেক কষ্ট করেছে। আমি বড় হয়ে বাবা-মাকে সুখে রাখব।

চাপারকোনা মহেশচন্দ্র স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র সিয়াম মিয়া এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে হরখালী মুজিবুর রহমান আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। মানবিক বিভাগের এই শিক্ষার্থীর পায়ের লেখায় মুগ্ধ তার সহপাঠী ও প্রতিবেশীরা। পরীক্ষায় বাড়তি আধা ঘণ্টা পেলেও সময় নিচ্ছে স্বাভাবিক ছাত্রদের মতোই। উদ্যমী সিয়াম মিয়া বড় হতে চায় সকলের মতো স্বাভাবিকভাবেই। তাই প্রতিবন্ধী কোটায় ভর্তি না হয়ে স্বাভাবিক জীবন গড়ার চেষ্টায় যুদ্ধ করে যাচ্ছে সিয়াম।

সিয়ামের সহপাঠী রিয়াদ বলে, সিয়ামের পায়ের লেখার কাছে আমাদের হাতের লেখা হেরে গেছে। ওর পায়ের লেখা অনেক সুন্দর। আর সিয়ামের লেখার গতিও অনেক ভালো। আমরা চাই, সিয়ামের ভবিষ্যৎ ভালো হোক।

সরিষাবাড়ি উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, আমরা এসব পরীক্ষার্থীদের আধা ঘণ্টা সময় বেশি দিই। কিন্তু সিয়াম কখনও সেই বাড়তি সময় নেয় না। সে নির্দিষ্ট সময়ে অন্যান্য পরীক্ষার্থীদের সাথে খাতা জমা দেয়। এটি একটি ভালো গুণ।

দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সিয়াম। তার বাবা জিন্নাহ মিয়া অসুস্থ থাকায় মা জোৎস্না বেগম শ্রমিকের কাজ করেন। ভূমিহীন এই পরিবারের পেটের ক্ষুধা মেটানোয় যখন দায়, সেখানে সিয়ামের লেখাপড়ার স্বপ্ন পূরণে হতাশ তারা।

সিয়ামের বাবা জিন্নাহ মিয়া বলেন, আমার নিজের কোনো জমি ও ঘর নেই। আমার মতো গরীব এই জগতে আর নেই। আমি দুইবার স্ট্রোক করেছি। এখন অসুস্থ থাকায় বাসায় বসা। সিয়ামকে কীভাবে লেখাপড়া করাব সেই চিন্তায় আমার ঘুম হয় না। আমরা কোনো দিশা পাচ্ছি না। আমার এই ছেলেটা শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পারে কি না?

সিয়ামের মা জোৎস্না বেগম বলেন, সিয়ামের বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে কখনও অন্যের বাড়িতে কাজ করেছি, আবার মাঠে কাজ করেছি। একেক সময় একেক কাজ করে সংসার চালাচ্ছি। আমার বড় দুই ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া শেষ করাইছি। একটা ছেলেকে কেন আমি বঞ্চিত করব। তাই হাজারও কষ্টের পরও তাকে লেখাপড়া করাইছি। কিন্তু আর পারছি না। কত মানুষ কত কথা বলছে। কিন্তু আমি কিছু শুনিনি। আমি আমার ছেলেকে লেখাপড়া করাইছি।

সিয়ামের মা বলেন, আমার ছেলের হাত না থাকায় ওর সব কাজ আমি করে দেই। কিন্তু আমি না থাকলে কি হবে ওর। সেই চিন্তায় ঘুম আসে না। এখন সিয়াম বড় হচ্ছে। ওর অনেক কিছু লাগে যেগুলো আমি করে দিতে পারি না। এসব বিষয় আমাকে অনেক দুঃখ দেয়।

অনেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেও কেউ খবর রাখে না বলে অভিযোগ তাদের। স্কুল কর্তৃপক্ষ কিছুটা সহায়তা করলেও আগামী দিনের চিন্তায় বিভোর তারা।

চাপারকোনা মহেশচন্দ্র স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সিয়ামের স্কুল ড্রেস থেকে শুরু করে বেতন, পরীক্ষার ফি সবকিছুই আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষ মওকুফ করে দিয়েছি। কিন্তু কলেজে তো এসবের সুযোগ কম। আমরা চিন্তায় আছি যে সামনের দিনে সিয়াম তার লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে কি না। সিয়ামের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সরকারের সাহায্য কামনা করেছেন তিনি।

নয়াশতাব্দী/টিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ