ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৮ জিলকদ ১৪৪৫

চার্জশিটে ‘তোড়জোড়’

প্রকাশনার সময়: ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:৩০ | আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:৩৯

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের তিন মাসে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২৩৪টি মামলার চার্জশিট হচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামিদের নাম ঠিকানা যাচাই শেষ হয়েছে। আসামি শনাক্ত ও তদন্তও শেষ পর্যায়ে। এরমধ্যে গ্রেফতার হয়ে অনেক নেতাকর্মী জেলে রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির নেতাদের দাবি, চাপে রাখতেই সরকার এ কৌশল নিয়েছে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, নিয়ম অনুযায়ী মামলা হয়েছে। ওই মামলার চার্জশিটও হবে। এরপর বিচারিক আদালতে তা জমা দেয়া হবে।

জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়ের হওয়া এসব মামলার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, পুলিশের কাজে বাধা দেয়া, হামলা, ককটেল বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোসহ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে। বেশিরভাগ মামলার বাদীও পুলিশ। বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, বিএনপিকে কোণঠাসা করতে এসব মামলা করা হয়েছে। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেও এমন অনেক মামলা হয়েছিল।

এর মধ্যে কাল্পনিক অভিযোগে মামলা হয়েছে বলেও দাবি করে আসছে বিএনপি। থানা–পুলিশ ও আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, গত অক্টোবরে ঢাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৬০টি। এরপর নভেম্বরে ১৩৩টি এবং ডিসেম্বরে ৪১টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনায় ঢাকার বিভিন্ন থানায় মামলা হয় ৩৬টি। এসব মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ দলটির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের নেতা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের দিন নয়াপল্টন ও এর আশপাশের এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা তাণ্ডব চালিয়েছিলেন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে মামলা হয়েছে। মামলায় যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, কেবল তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

অনেক মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই এসব মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে। বিএনপির দলীয় সূত্রগুলো বলছে, ২৮ অক্টোবরের পর মামলা দেয়া যেমন বেড়েছে, গ্রেপ্তারও বেড়েছে অনেক। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে চলতি জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সারা দেশে তাদের ২৭ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় বিরোধী দলের ৩ হাজার ১৫৬ জনকে গ্রেপ্তার হয়েছে। এ সময়ে পুলিশের ব্যাপক অভিযানের মুখে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বড় অংশই আত্মগোপনে চলে যায়।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কায়সার কামাল দাবি করেন, ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ পণ্ড করে নাশকতার দায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর চাপিয়ে একের পর এক রাজনৈতিক মামলা করেছে পুলিশ। তিনি বলেন, ১ অক্টোবর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সারা দেশে ৭৩৮টি মামলা হয়েছে। এখন এসব মামলার চার্জশিট দেয়া হলে তা হবে বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল।

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি বলেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপির নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। নাশতকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলার ঘটনার সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতা থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা হবে।’

জানা গেছে, ঢাকা মহানগরে ৫০টি থানা রয়েছে। বিএনপির নেতাদের আইনজীবীদের তথ্য ও ঢাকার আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্য বলছে, ১ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকার ৪৫টি থানায় বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ২৩৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে ৫ হাজার ৮৬৮ জনকে। এর বাইরে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও প্রায় ৩ হাজার জনকে। এ তিন মাসে সর্বাধিক মামলা হয় যাত্রাবাড়ী থানায়— মামলার সংখ্যা ২৬। পল্টন থানায় ২২টি, রমনায় ১২টি, পল্লবীতে ১১টি, মিরপুরে ১১টি, মতিঝিলে ১০টি ও ডেমরা থানায় ৮টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।

সাতটি করে মামলা হয়েছে খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, শাহ আলী ও কাফরুল থানায়। ছয়টি করে মামলা শ্যামপুর, দারুসসালাম, হাতিরঝিল, ভাটারা ও ওয়ারী থানায়। পাঁচটি করে মামলা হয় মোহাম্মদপুর, শেরেবাংলা নগর, কদমতলী ও মুগদা থানায়। চারটি করে মামলা হয় ধানমন্ডি ও সবুজবাগে। তিনটি করে মামলা হয় চকবাজার, বনানী, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, বাড্ডা, হাজারীবাগ, উত্তরা পূর্ব, ভাষানটেক, রামপুরা ও গেন্ডারিয়ায় থানায়। দুটি করে মামলা লালবাগ, বংশাল, উত্তরা পশ্চিম, খিলক্ষেত, শাহবাগ, রূপনগর ও নিউমার্কেট থানায়। একটি করে মামলার তথ্য পাওয়া গেছে আরও সাতটি থানায়। এ সময়ে পাঁচটি থানায় (কামরাঙ্গীর চর, গুলশান, উত্তরখান, আদাবর, তুরাগ থানা) বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন মামলার তথ্য পাওয়া যায়নি।

এসব থানায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত তদারক সূত্রে জানা গেছে, বেশিরভাগ মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। দ্রুতই চার্জশিট দাখিল করা হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মতিঝিল থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, দ্রুতই মামলার তদন্ত শেষ করার জন্য সিনিয়র কর্মকর্তাদের চাপ রয়েছে। আসা করা যাচ্ছে চলতি মাসের শেষেই আদালতে চার্জশিট দাখিল করা সম্ভব হবে।

ঢাকার আদালতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ইলতুৎমিশ সওদাগর বলেন, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন, এমন প্রায় দুইশ নেতাকর্মীকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগপর্যন্ত তাদের মক্কেলদের জামিন আবেদন নাকচ হয়েছে।

তবে নির্বাচনের পর অনেকে জামিন পেয়েছেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা-কর্মীদের রাজনীতির মাঠ থেকে বিতাড়িত করতে অতীতের মতো এবারও সরকার একের পর এক মামলা ও গ্রেপ্তার করেছে। তার দাবি, এই সরকার ফৌজদারি মামলাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের নজির স্থাপন করেছে।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ