ঢাকা, শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

যেমন ছিলেন তাঁদের জননীরা

প্রকাশনার সময়: ২১ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩৩

(প্রতিটি মানুষের জন্য তার প্রথম বিদ্যালয় মায়ের কোল। মায়ের কাছ থেকে মানুষ যা শেখে জীবনভর সেটাই হয়ে থাকে তার জীবনের সেরা শিক্ষা। তাই দেখা যায় পৃথিবীর অধিকাংশ মনীষীর পেছনে লুকিয়ে থাকে তাঁর মায়ের অবদান। উপমহাদেশের কয়েকজন মনীষীর মায়ের গল্প নিয়ে এ লেখা)

খাজা নিজামুদ্দীন আওলিয়া (রহ.)-এর মাতা

খাজা নিজামুদ্দীনের বয়স পাঁচ বছর হলে তাঁর বাবা ইন্তেকাল করেন। মা সে সময়ের একজন নেককার আল্লাহওয়ালা নারী ছিলেন। এই এতিম বাচ্চার সার্বিক তত্ত্বাবধান, দ্বীনি ও আখলাকি তরবিয়তসহ পিতৃ দায়িত্বের সবটুকুই এ মাকেই কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল।

পাগড়ি গ্রহণের সময় এলে উস্তাজ পাগড়ি নিয়ে আসতে বললেন। খাজা নিজামুদ্দীন (রহ.) মাকে বললেন, মা! উস্তাজ পাগড়ি নিয়ে যেতে বলেছেন; পাগড়ি কোথায় পাব? মা বললেন, বাবা অস্থির হয়ো না, আমি ব্যবস্থা করছি। অনেক কষ্টে মা পাগড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। পাগড়ি গ্রহণের এই বরকতপূর্ণ অনুষ্ঠানে তাঁর মা সময়ের বড় বড় আলেম ও বুজুুর্গদের দাওয়াত করেছিলেন।

খাজা নিজামুদ্দীন বলেন, মায়ের একটি অভ্যাস ছিল, যেদিন খাবারের কোনো ব্যবস্থা থাকত না, সেদিন বলতেন, আমরা সকলেই আজ আল্লাহর মেহমান। ‘আল্লাহর মেহমান’ হওয়ার এই বোলটি আমার কাছে বেশ আনন্দের বিষয় ছিল। (কারণ আল্লাহর মেহমানকে তো আল্লাহ তাঁর শান অনুযায়ীই মেহমানদারি করাবেন)

একদিন আল্লাহর এক বান্দা বাড়িতে এক ঝুড়ি খাদ্যশস্য দিয়ে গেল। তা দিয়ে বেশ কয়েক দিন চলল। কিন্তু এই খাদ্য শেষ হতে দেরি হওয়ায় আমার মাঝে অস্থিরতা সৃষ্টি হলো। কেননা এ খাবারগুলোর কারণেই মায়ের মুখ থেকে ‘আল্লাহর মেহমান’ হওয়ার সেই মজার বাক্যটি শুনতে পারছি না।

একসময় তা শেষ হলো। এবার মা জানিয়ে দিলেন, আজ আমরা আল্লাহর মেহমান। এ কথা শুনে আমি যারপরনাই আনন্দিত হলাম।একদিন হজরত খাজা তার মায়ের মৃত্যুর আলোচনা শুরু করলেন। একপর্যায়ে এমন কান্না শুরু করলেন যে, তাঁর কথাগুলো বোঝা যাচ্ছিল না। খাজা (রহ.) একদা নতুন চাঁদ দেখে অভ্যাসানুযায়ী মায়ের কাছে এসে নতুন চাঁদের মোবারকবাদ জানালেন। মা তখন বললেন, আগামী মাসের চাঁদ দেখে কাকে মোবারকবাদ জানাবে? তাঁর আর বুঝতে বাকি রইল না- মায়ের বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তিনি কাঁদতে শুরু করলেন আর তাঁর অন্তর ভারি হয়ে এলো।

বললেন, মা! আপনি এই অসহায়কে কার কাছে রেখে যাচ্ছেন? মা জবাব দিলেন, কাল বলব। আমি মনে মনে বললাম, কী ব্যাপার! আজ জবাব দিচ্ছেন না কেন? সঙ্গে এও বললেন, যাও আজ শায়েখ নজীবুদ্দীনের কাছে থাক। কথামতো আমি তাঁর কাছে গেলাম।

শেষ রাতে সুবহে সাদিকের কিছু পূর্বে মায়ের খাদিমা দৌড়ে এসে বলল, বেগম ছাহেবা (খাজা ছাহেবের মা) তোমাকে ডাকছেন। আমি গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছেন? জবাবে বললেন হ্যাঁ, ভালো আছি। তারপর বললেন, কাল তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে, কার কাছে তোমাকে রেখে যাচ্ছি, আমি তোমাকে আজকে জবাব দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলাম। শোনো, আমি এখন সেই প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। তোমার ডান হাত বের করো। আমি হাত বের করে দিলাম। আমার ডান হাতকে তিনি তার ডান হাতে নিয়ে বললেন, হে আল্লাহ! আমার এই কলিজার টুকরাকে তোমার কাছে সোপর্দ করছি। একথা বলেই তিনি ইন্তেকাল করলেন।

এ কথায় আমি এমন খুশি হয়েছি যে, আমার মমতাময়ী মা যদি আমার জন্য ঘরভর্তি স্বর্ণ ও মনি-মুক্তা রেখে যেতেন তাহলেও আমি এত খুশি হতাম না। (কারণ আল্লাহ যার অভিভাবক হয়ে যাবেন, তার আর চিন্তা কী?)

সায়্যিদ আহমদ শহীদ রায়বেরেলি (রহ.)-এর মাতা

এমন মায়ের সংখ্যা খুব বেশি হবে না, যিনি সন্তানের জানের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সফল হয়েছেন। হজরতের মাতা তাকে মৃত্যুর হাতে সোপর্দ করেছিলেন; যার নমুনা হজরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা.)।

একদা সায়্যিদ আহমাদ এক যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন। দাইমা যেতে দিচ্ছিলেন না। মা নামাজে ছিলেন, সায়্যিদ সাহেব অপেক্ষায় ছিলেন- মা নামাজ শেষ করলে তারপর অনুমতি নেবেন। সালাম ফিরিয়ে তাঁর মা দাইমাকে বললেন, আহমাদের সঙ্গে আপনার মহব্বতের সম্পর্ক অবশ্যই আছে তবে তা আমার মতো নয়। এখন বাধা দেয়ার সময় নয়। যাও, আল্লাহর নাম নিয়ে বের হয়ে পড়। জিহাদের ময়দান থেকে পিঠ ফেরাবে না। অন্যথায় তোমার চেহারাও দেখাবে না আমাকে।

মাওলানা ফজলুর রহমান গঞ্জ মুরাদাবাদি (রহ.)-এর মাতা

তাঁর মাতা একজন বড় দুনিয়াবিরাগী ও তাওয়াক্কুলের অধিকারী বুজুুর্গ ছিলেন। তিনি বলেন, আমার ১১-১২ বছর বয়সে আমার বাবা ইন্তেকাল করেন। মায়ের নিকট জমানো কিছু পয়সা ছিল, ধীরে ধীরে তাও শেষ হয়ে গেল। তারপর এলো চরম অভাবের দিন। এ সময় আমার মা সর্বদা দরজা বন্ধ রাখতেন। আর বাড়িতে থাকা শাক-লতাপাতা সেদ্ধ করে খেয়ে নিতেন। আর এ দুরবস্থার কথা কাউকেই বুঝতে দিতেন না। অথচ এমন অসংখ্য মানুষ ছিল, যারা সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন; কিন্তু তা তাঁর জন্য গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না।

মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস কান্ধলভী (রহ.)-এর মাতা

মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) মুজাফফরনগর জেলার বিখ্যাত বংশের সন্তান ছিলেন। যার অবদানেই দাওয়াত ও তাবলিগের বিশ্বব্যাপী মেহনত দ্বারা মানুষ উপকৃত হচ্ছে। এ বংশকে সেসময় খোদাভীরুতা ও দ্বীনদারির মারকাজ মনে করা হতো।

এ খানদানের পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ইবাদত বন্দেগি, রাত্রি জাগরণ, জিকির ও তিলাওয়াতের বিবরণ সাধারণ মুসলিমদের বিস্মিত না করে পারে না।

ঘরের মহিলারা রমজানে একা একা নফল নামাজে কোরআন খতম করা ছাড়াও ঘরের পুরুষদের পেছনে তারাবি ও নফলে কোরআন শুনতেন। এটা ওই পরিবারের ঐতিহ্য ছিল।

রমজান মাস ছিল তাদের কাছে কোরআন তিলাওয়াতের বসন্তকাল। ঘরগুলো আবাদ থাকত কোরআন তিলাওয়াতের গুঞ্জনে। কোরআন তরজমা, উর্দু তাফসির, মাজাহেরে হক (মিশকাতের উর্দু ভাষ্যগ্রন্থ) মাশারিকুল আনওয়ার, হিসনে হাসিন- এ পুস্তকগুলো নারীদের পারিবারিক সিলেবাস ছিল। যার পাঠন-পঠনের ব্যাপক প্রচলন ছিল।

তাদের ঘরের ভিতর ও বাহিরের মজলিসগুলোতে সায়্যিদ আহমদ শহীদ ও শাহ আবদুল আযীয (রহ.)-এর আলোচনা খুব বেশি হতো। তাদের জীবনের কীর্তি ও অবদানগুলো পরিবারের নারী-পুরুষদের মুখে মুখে চর্চা হতো। মেয়েরা মায়েরা বাচ্চাদেরকে তোতা-ময়নার গল্পের পরিবর্তে এ বুজুর্গদের ঘটনা শোনাতেন।

একদিন মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) পরিবারের মায়েদের এসব ঘটনা ও বিবরণ শোনানোর পর বললেন, এঁদের কোলে কাঁখেই আমরা প্রতিপালিত হয়েছি। এখন আর এমন কোল দুনিয়াতে কোথায় পাবে!

মাওলানার নানি বিবি আমাতুর রহমান মাওলানা মুজাফফর হুসাইন (রহ.)-এর কন্যা ছিলেন; যাকে এ বংশে সকলে উম্মি-বি নামে চেনে। তিনি এ কালের রাবেয়া বসরীয়া ছিলেন। জীবনসন্ধ্যায় ইবাদত বন্দেগির কারণে খাবারের চাহিদাও কমে গিয়েছিল। ঘরের লোকজন যদি তাঁর কাছে খাবার নিয়ে যেত, তাহলে খেতেন নতুবা খেতেন না। কর্ম ব্যস্ততার কারণে যদি ঘরের লোকজন ভুলে যেত, সেদিন অনাহারেই দিন কেটে যেত। কেউ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি এভাবে ক্ষুধা নিয়ে কীভাবে থাকেন? জবাব দিলেন, আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে আলহামদুলিল্লাহ খাবারের ব্যবস্থা হয়।

ইলিয়াস (রহ.)-এর মাতা একজন বড় হাফেজা ছিলেন। তিনি বিবাহের পর কোরআন হিফজ করেন। এত মজবুত হাফেজা ছিলেন যে, কোনো সাধারণ হাফেজ তাঁর সামনে তিলাওয়াত করা কঠিন ছিল। রমজানে প্রতিদিন এক খতম দশ পারা পড়ার রুটিন ছিল। এই তিলাওয়াতের কারণে সাংসারিক কাজে মোটেও ব্যত্যয় ঘটত না। মুখে তিলাওয়াত আর হাতে কাজ- এভাবে তিলাওয়াত জারি থাকত তাঁর।

এমন মায়ের গর্ভেই জন্ম নিয়েছেন মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর মতো দ্বীনের মহান দায়ীগণ।

আল্লামা ইকবাল (রহ.), যার কবিতা ঈমানী চেতনায় দীপ্ত। যিনি তার কবিতার মাধ্যমে উম্মতে মুসলিমাকে নবচেতনায় উদ্দীপ্ত করেছেন। তিনি বলতেন, আমার মধ্যে আল্লাহ রাসুল এবং দ্বীন ইসলামের প্রতি যে বিশ্বাস ও ভালোবাসার স্ফুলিঙ্গ দেখতে পাও তা লাভ করেছি মায়ের কোল থেকে, তাঁর তরবিয়তে। এজন্যই উম্মতের প্রয়োজন ঈমানি চেতনায় দীপ্ত মায়ের কোল। যাদের গর্ভে জন্ম নেবে রত্ন-মানিক। উম্মতের রাহবার।

(ইসলাম মে আওরাত কা দারজাহ আওর উসকে হুকূক ওয়া ফারায়েয (পৃ. ২৪৬-২৫০) কিতাব থেকে) ভাষান্তর: মাওলানা আব্দুল মজিদ

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ