ঢাকা, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, ২০ মহররম ১৪৪৬

ইফতারে কোন দেশে কী খাওয়া হয়?

প্রকাশনার সময়: ০১ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৪৩

ইসলামিক ক্যালেন্ডার বা হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, রমজান হলো সবচেয়ে পবিত্র মাস। এই মাসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মাসব্যাপী রোজা রাখেন। পুণ্য অর্জন ও আত্মশুদ্ধির আশায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তারা পানাহার থেকে বিরত থাকেন। মাগরিবের আজান শুনে মুখে খাবার তুলে রোজা ভাঙেন। রোজা ভাঙার এ সময়কে বলা হয় ‘ইফতার’। অনেক দেশে এটি ‘ইফতর’ নামেও পরিচিত।

জনসংখ্যাবিষয়ক অনলাইন ডেটাবেজ ‘ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ’ (ডব্লিউপিআর) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২০০ কোটি মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী।

এ বিশাল জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ নিয়মিত রোজা রাখেন এবং দিনশেষে ইফতারও করেন। কিন্তু ধর্ম এক হলেও দেশে দেশে সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে তাদের সবার ইফতার আয়োজন এক না। বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের ইফতার আয়োজনে রয়েছে বৈচিত্র্য।

যদিও প্রায় সব দেশেই সাধারণত খেজুর বা পানির মতো হালকা কিছু দিয়ে ইফতার শুরু হতে দেখা যায়, কিন্তু দেশে দেশে ইফতার আয়োজনে বাহারি পদের খাবার দেখা যায়।

পাকিস্তান

সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলিম বসবাস করে পাকিস্তানে। ডব্লিউপিআর-এর তথ্য বলছে, দেশটির মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯৮ ভাগেরও বেশি অর্থাৎ ২৪ কোটি মানুষ মুসলিম।

পাকিস্তানে ইফতার আয়োজনে পানি এবং খেজুর তো থাকেই তবে প্রাধান্য পেতে দেখা যায় মাংস ও রুটির মতো সেখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো।

নানা ধরনের কাবাব, তান্দুরি, কাটলেট, টিক্কার উপস্থিতি প্রায় প্রতিদিনের ইফতারেই রেখে থাকেন বড় অংশের পাকিস্তানি।

এসব ভারি খাবারের পাশাপাশি ইফতারের সময় বিভিন্ন ভাজাপোড়া খাবারও খেয়ে থাকেন তারা। যেমন- রোল, নিমকি, মাংস ও সবজি দিয়ে তৈরি করা এক ধরনের বিশেষ সমুচা, বিভিন্ন ধরনের চপ, পাকোড়া ইত্যাদি।

এ ছাড়া নানা রকম শরবত, ফল বা ফলের সালাদ, ছোলা-বুট, ফালুদা, জিলাপি, এমনকি বিরিয়ানি দিয়েও তাদের ইফতারের টেবিল সাজানো হয়। তবে পানীয় হিসেবে রুহ আফজার কদর এ দেশে সবচেয়ে বেশি।

ইন্দোনেশিয়া

ডব্লিউপিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ দেশটির প্রায় সাড়ে ২৩ কোটি মানুষ মুসলিম।

দেশটির মানুষজন ইফতারে তেল ও মসলা জাতীয় খাবারের পরিবর্তে বিভিন্ন রকম ফল এবং ফলের শরবতকে প্রাধান্য দেয়। এ ছাড়া তাদের ইফতার আয়োজনে নানা রকম মিষ্টি জাতীয় খাবারও থাকে।

ইন্দোনেশিয়ার সংবাদপত্র দ্য জাকার্তা পোস্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুবুর চ্যান্ডিল নামক এক ধরনের মিষ্টান্ন; মিষ্টি আলু দিয়ে তৈরি বিজি সালাক; কলা, মিষ্টি আলু অথবা কুমড়া দিয়ে তৈরি কোলাক; কলা দিয়ে তৈরি এস পিসাং ইজো সহ আরও নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার এ সময় ইন্দোনেশিয়ানরা তৈরি করে থাকে।

ভারত

জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বর্তমানে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। দেশটির ১৪ শতাংশ অর্থাৎ ২০ কোটি মানুষ হলো মুসলিম। তবে সংখ্যায় হিসেব করলে এটি মোটেও কম নয়।

বিশাল আয়তনের এ দেশটির একেক রাজ্যের ইফতার আয়োজনে একেক খাবার জনপ্রিয়।

যেমন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন বলছে, ভারতের হায়দ্রাবাদের মুসলিমরা ইফতারে হালিম খেতে পছন্দ করেন। আবার কেরালা ও তামিল নাড়ুর মুসলমানরা ইফতার করেন ‘নমবু কাঞ্জি’ নামে এক ধরনের খাবার দিয়ে।

নমবু কাঞ্জি হলো মাংস, সবজি এবং পরিজের সমন্বয়ে তৈরি এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার।

তবে সামগ্রিকভাবে দেখলে ভারতেও ইফতারে ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার খাওয়ার চল আছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের অলিতে-গলিতে ইফতারের আগে আগে নানা ধরনের পাকোড়া, সমুচা, চপ ইত্যাদি বিক্রির ধুম পড়ে যায়।

তবে দিল্লিসহ দেশটির উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে ইফতারের শুরুতে পানির সঙ্গে থাকে খেজুর, ছোলা-বুট, হরেক রকম ফল ও ফলের শরবত, দুধ, ডিম, দইয়ের মতো খাবার।

ভারি খাবারের মাঝে থাকে বিভিন্ন ধরনের কাবাব, হালিম, কাটলেট, শর্মা, স্যুপ, বিরিয়ানি ইত্যাদি।

নাইজেরিয়া

ডব্লিউপিআর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সর্বোচ্চ মুসলিম জনগোষ্ঠী বসবাসের দিক থেকে শীর্ষ দশের মাঝে আছে পশ্চিম আফ্রিকান দেশ নাইজেরিয়াও।

যদিও দেশটিতে মুসলিম আছে ৯ কোটি ৭০ লাখ, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪২ শতাংশ।

নাইজেরিয়ার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ইফতারে শর্করা জাতীয় খাবার ও ফলমূলকে প্রাধান্য দেয়া হয়।

যেমন- জল্লফ রাইস, এটি নাইজেরিয়ানদের অন্যতম প্রধান খাবার। চাল, পেঁয়াজ, টমেটো, মরিচ ইত্যাদির সমন্বয়ে এটি তৈরি করা হয়। এটি তারা সবজি বা মাংসের সঙ্গে খান।

পাশাপাশি মই মই (পুডিং), ইয়াম (এক ধরনের আলু), আকারা (বিন কেক), মাসা (রাইস কেক), ইলুবো ও আমালার (ইয়াম দিয়ে তৈরি এক বিশেষ খাবার) মতো আরও নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবারও তাদের ইফতার তালিকায় থাকে।

মিশর

রহস্যঘেরা পিরামিড আর নীলনদের দেশ মিশরে ৯ কোটি মানুষ মুসলিম। দেশের মোট জনসংখ্যার হিসেবে মুসলিমরা প্রায় ৭৯ শতাংশ। দেশটিতে ইফতার মানেই একধরনের আনন্দ-উৎসব।

মিশরের মুসলিমরা ইফতারের সময় মৃদু আলো দেয় এমন রঙিন লণ্ঠন জ্বালিয়ে থাকেন। শুধু তাদের বাড়িতে নয়, পুরো রমজানজুড়ে সেখানকার পথেঘাটেও বিভিন্ন ধরনের রঙিন আলো জ্বলতে দেখা যায়।

রমজানে তাদের ইফতার টেবিলে থাকে নানা ধরনের খাবারের সমারোহ। তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘আতায়েফ’ ও ‘কুনাফা’। আতায়েফ হলো এক ধরনের প্যানকেক ও কুনাফা এক ধরনের সিরাপ।

এ দুটো খাবার মিশরীয় মুসলমানদের ইফতারের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলা যেতে পারে। তবে দেশটির অনেক পরিবার ইফতারে বাদামি রুটি এবং মটরশুঁটি, টমেটো, বাদাম ও অলিভ অয়েল দিয়ে তৈরি ‘ফুল মেদেমাস’ নামক এক ধরনের খাবার খেতে পছন্দ করেন। মিডল ইস্ট আইয়ের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিশরীয়রা তাদের ইফতারে এপ্রিকটস ফল দিয়ে তৈরি কামার-আল-দিনান্দ আরায়সি এবং দুধ, ভ্যানিলা ও নারিকেল দিয়ে তৈরি সোবিয়া নামক পানীয় পান করেন।

এ ছাড়া তাদের খাবার টেবিলে বিভিন্ন ধরনের ফল, ফলের রস, সবজি ইত্যাদিও থাকে।

তুরস্ক

তুরস্কের ৯৮ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় আট কোটি মানুষ মুসলিম। দেশটির বিভিন্ন খাবার এখন শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ নয় বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এগুলো ‘টার্কিশ ফুড’ নামে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

তবে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর মতো ইফতারে তাদেরও পছন্দের শীর্ষে থাকে খেজুর। সেইসঙ্গে বিভিন্ন ফলমূল, শরবত, হরেক রকম কাবাব তাদের খাদ্য তালিকায় থাকে। তবে রমজানে দেশটির মুসলমানদের সবচেয়ে পছন্দের খাবার হলো রামাজান পিদেসি, যা মূলত এক ধরনের রুটি।

এটি নান রুটির মতো একই পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়। প্রথমে ময়দার সঙ্গে দুধ, মাখন, জলপাই দিয়ে খামির তৈরি করা হয়। পরে রুটির ভিতর ডিম ও গরুর মাংসের পুর দিয়ে সেটিকে চুলায় বেক করা হয়।

ইরান

ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান, যার ৯২ শতাংশ মানুষ (আট কোটি ২৫ লাখ) মানুষ মুসলিম।

রুটি, স্যুপ, র‍্যাপ, কাবাবের মতো সুপরিচিত খাবারের পাশাপাশি ইফতারে ইরানের ঘরে ঘরে তৈরি হয় জাফরানের ঘ্রাণযুক্ত এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী পার্শিয়ান হালুয়া।

এ ছাড়া জাফরান চাল দিয়ে তৈরি ‘শোলেহ জার্দ’ নামক এক ধরনের পুডিংও ইরানিদের খুব প্রিয়।

পার্শিয়ান নুডুলস, সবজি, পেঁয়াজ, বিন ইত্যাদি দিয়ে তৈরি আশ রাসতেহ নামক ঘন স্যুপ ও হালিমও সেখানে ইফতারের সময় আগ্রহ নিয়ে খাওয়া হয়।

সেইসঙ্গে তাদের ইফতারে আরও থাকে স্যান্ডউইচ, চা, তাবরেজি চিজ, জুলবিয়া (বাংলায় যাকে জিলাপি বলা হয়, বামিয়েহ নামক এক ধরনের মিষ্টান্ন ইত্যাদি।

উল্লেখ্য ইরানের অন্যতম প্রধান খাবার হলো খেজুর। তাই ইফতার টেবিলে এর উপস্থিতি অনেকটাই অপরিহার্য।

আলজেরিয়া

উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৫ শতাংশ মুসলিম।

ডব্লিউপিআরের হিসাবে, দেশটিতে মাত্র সাড়ে চার কোটি মুসলিম বসবাস করে। জনসংখ্যার দিক থেকে শীর্ষ মুসলিম দেশগুলোর মাঝে এর অবস্থান দশম।

আলজেরিয়ান মুসলিমরা পিজ্জা ‘সোয়ারবা’, সবজি রোল, আলু, সবজি দিয়ে তৈরি দোলমা ইত্যাদি দিয়ে তাদের ইফতার শুরু করেন।

মাগরিবের নামাজের পর তারা ‘সিগার’ নামক এক ধরনের পানীয় পান করেন, যা বাদাম দিয়ে তৈরি। এ ছাড়া তাদের ইফতারের তালিকায় বিভিন্ন স্যুপও থাকে।

সৌদি আরব

মুসলিম দেশগুলো নিয়ে আলোচনা করলে সৌদি আরবের কথা না বললেই নয়। যদিও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে শীর্ষ দশে নেই দেশটি। ডব্লিউপিআরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরবে মোট সোয়া তিন কোটি মুসলিম বসবাস করে, যা দেশটির মোট জনংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশ।

আরব নিউজের এক প্রতিবেদন বলছে, সৌদিরা ইফতারের শুরুতে ‘গাহওয়া’ নামক অ্যারাবিক কফি পান করেন এবং সেইসঙ্গে অবশ্যই খেজুর খান। এরপর তারা মাগরিবের নামাজ পড়েন।

নামাজ শেষে তারা ভারি খাবার খান। সৌদি আরবেও অঞ্চলভেদে ইফতারের খাবারে ভিন্নতা রয়েছে। দেশটির পশ্চিম অঞ্চলের মানুষ তাদের ইফতারে শৌরাইক রুটি ও দুজ্ঞাহ নামক ঐতিহ্যবাহী খবার খান।

আবার পূর্বাঞ্চলের লোকেরা ইফতারে সালুনা নামের একটি খাবার খান, যা মাংস ও সবজির স্টু দিয়ে তৈরি।

দেশটির কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মানুষ তাদের রোজা ভাঙেন আসিদাহ, মারগগ, মাফরৌক ও মাতাজিজ নামক ঐতিহ্যবাহী খাবার দিয়ে। এগুলো বাদামি আটা, গরুর মাংস, সবজি, মধু, পেঁয়াজ বা ঘি দিয়ে তৈরি করা হয়। দেশটির আরেকটি জনপ্রিয় খাবার থারিদ, যা মূলত ভেড়ার মাংস ও সবজি দিয়ে তৈরি স্যুপ জাতীয় খাবার।

ইফতারকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি বিশ্বজুড়েই ইফতারের আয়োজন মানেই মুসলিমদের কাছে যেন উৎসব। যারা রোজা পালন করেন না তাদের অনেকেও ইফতারের আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।

যেমন- শিশুদের জন্য রোজা রাখার বিধান না থাকলেও অনেক পরিবারেই দেখা যায় যে বড়দের পাশাপাশি তরুণরা, এমনকি শিশুরাও ইফতারের খাবার প্রস্তুত করতে এগিয়ে আসে। তবে পরিবারের সঙ্গে ইফতার করার পাশাপাশি অনেক মুসলিম মসজিদে গিয়ে সবার সঙ্গে মিলেমিশে ইফতার করেন। এতে সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মজবুত হয়।

ইফতারের অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর একে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। ইফতারকে বিশ্বের ‘অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের’ স্বীকৃতি দিতে তুরস্ক, ইরান, উজবেকিস্তান ও আজারবাইজান ইউনেস্কোর কাছে যৌথভাবে আবেদন করেছিল।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ