ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫
মদিনা শরিফের জুমার খুতবা

রমজান মাসের শ্রেষ্ঠ আমল

প্রকাশনার সময়: ১৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৪, ০৭:৪৪

এইতো রমজান মাস যার নূর আগমন করেছে, এর সূর্যালোক উদ্ভাসিত হয়েছে। এর জন্য বান্দার হূদয়ে রয়েছে সবচেয়ে উজ্জ্বল মর্যাদা এবং অন্তরে রয়েছে ভালোবাসা ও প্রাধান্য। এর দিনগুলো করুণার ভান্ডার এবং রাতগুলো ক্ষমা ও উপহারে পরিপূর্ণ।

মুসলিম ব্যক্তির নিকট যখন আনুগত্যের মৌসুম আসে, তখন তা পেয়ে সে খুশি হয় এবং তার কাঁধ থেকে আলস্যের ধূলিকণা ঝেড়ে ফেলে ও প্রচেষ্টার বাহুকে দ্রুত পরিচালিত করে। যেন কল্যাণের মৌসুমকে মূল্যায়ন করতে পারে- যা হয়তো তার নিকট পুনরায় ফিরে আসবে না এবং ইবাদতের সময়গুলোকে কাজে লাগাতে পারে- যা হাতছাড়া করা উচিত নয়। সে ক্ষমা ও জান্নাতের লাভের জন্য প্রতিযোগিতা করে।

আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন (তওবা)

মহাবিশ্বের সবচেয়ে আনন্দদায়ক ও জীবনের সবচেয়ে সুন্দর জিনিস এবং উত্তম নিয়ামত ও চক্ষু শীতলকারী বিষয় হলো, মহান আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন। আর আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের সারমর্ম হলো অন্তরকে তাঁর অভিমুখী করা; এভাবে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টিকে আপনার লক্ষ্য বানিয়ে নেয়া এবং সর্বদা তাকে স্মরণে রাখা; যেন আপনি অন্তরকে আল্লাহর মহব্বতে পরিপূর্ণ করতে পারেন। রমজান মাসে ও ব্যক্তির সমগ্র জীবনজুড়ে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করার পথগুলো উন্মুক্ত, বৈচিত্র্যময় ও শরিয়তসিদ্ধ; ফলে এগুলোতে মানুষের ব্যস্ত হওয়া জরুরি।

সিয়াম সাধনা

আল্লাহর দিকে ফিরে আসার সবচেয়ে সুন্দর একটি নমুনা হলো সিয়াম সাধনা; একজন মুসলমান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তার খাদ্য ও পানীয় পরিত্যাগ করে। যে ব্যক্তি সাওম রেখে আল্লাহর অভিমুখী হয়, আল্লাহ তাকে অবর্ণনীয় পুরস্কার ও ফেরত অযোগ্য অনুগ্রহ দান করবেন। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আদম সন্তানের প্রতিটি সৎকাজের প্রতিদান দশ গুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তবে রোজা ব্যতীত; তা আমার জন্যই এবং আমিই তার প্রতিদান দেব। সে তার প্রবৃত্তি ও পানাহার আমার জন্যই ত্যাগ করে। রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে: একটি আনন্দ তার ইফতারের সময় এবং আরেকটি তার প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। রোজাদার ব্যক্তির মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট কস্তুরীর ঘ্রাণের চেয়েও অধিক সুগন্ধময়।’ (মুসলিম)

সিয়াম ও সালাত

সালাত আদায় হলো আল্লাহর দিকে শ্রেষ্ঠ প্রত্যাবর্তন; কেননা তাঁর সামনে আপনার দাঁড়ানোর অর্থ তাঁর সঙ্গে আপনার একান্তে আলাপচারিতা করা; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন সালাতরত থাকে, তখন সে তার রবের সঙ্গে একান্তে আলাপ করে।’ (মুসলিম)

সে তাঁর সঙ্গে তাঁর প্রশংসা করে, বিনয়-নম্রতা প্রকাশ করে এবং কাকুতি-মিনতি করে মোনাজাত করে; যাতে তিনি ক্ষমা ও দয়া করেন, নিরাপত্তা ও সুস্থতা দান করেন এবং হেদায়াত ও রিজিক প্রদান করেন। যদি তার হূদয় এসব মর্ম অনুধাবন করে; তাহলে সে ইবাদতের স্বাদ এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের আনন্দের তৃপ্তি নিয়ে সালাত শেষ করবে। তাছাড়া রমজানে সালাত হলো প্রশান্তি ও সুঘ্রাণস্বরূপ এবং অগণিত কল্যাণের উপলক্ষ্য।

কোরআন তিলাওয়াত

আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত পাঠ করা পাঠকারীর অগ্রগামিতা বৃদ্ধি করে এবং এর প্রতিটি হরফ তাকে স্রষ্টার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনে আরও নিকটবর্তী করে। যদি রমজান ও কোরআন একত্রিত হয়, তাহলে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না সেই নিয়ামত থেকে যা লাভ করে ওইসব অগ্রগামীরা, যাদেরকে তা তিলাওয়াতের কারণে পরম করুণাময় রহমতে আচ্ছন্ন করে রাখেন।

যখনই আপনি কোরআনের দিকে তা তিলাওয়াত ও গবেষণার মাধ্যমে অগ্রসর হবেন; আল্লাহ আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসবেন, আপনার মর্যাদা অনেক উন্নত হবে, আপনার প্রতিদান বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে এবং আপনার জীবন আলোকিত হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন কোরআনের পাঠককে বলা হবে, তুমি তা পাঠ করতে থাক এবং উপরে উঠতে থাক। তুমি তা ধীরে সুস্থে পাঠ করতে থাক, যেরূপ তুমি দুনিয়াতে পাঠ করতে। কেননা তোমার সর্বশেষ বসবাসের স্থান (জান্নাত) ওইখানেই যেখানে তোমার কোরআনের আয়াত শেষ হবে।’ (সুনানে আবু দাউদ; আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত)

জিকির-আজকার

আপনার সামনে মহান আল্লাহর অভিমুখী হওয়ার একটি শরিয়তসম্মত বিশাল দ্বার হলো সকাল-সন্ধ্যায়, দাঁড়িয়ে-বসে আল্লাহর জিকির করা। আল্লাহর অভিমুখী ব্যক্তি রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে লাভবান হয়। কেননা এটি হালকা ছায়ার ন্যায়, দ্রুত অতিক্রমকারী, এর পুরস্কার মর্যাদাপূর্ণ এবং ফজিলত বিশাল। বুখারিতে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: আমি আমার বান্দার কাছে তার ধারণা অনুযায়ী থাকি। যখন সে আমার জিকির (আমাকে স্মরণ) করে তখন আমি তার সঙ্গী হয়ে যাই। যখন সে একাকী (মনে মনে) আমার জিকির করে তখন আমি একাকী তাকে স্মরণ করি। যখন সে কোনো মজলিসে আমার জিকির করে তখন আমি তাকে তার চাইতে উত্তম মজলিসে স্মরণ করি।’ সুতরাং কতই না চমৎকার হবে রমজান মাসে যখন রোজাদারের জিহ্বা ও নম্র হূদয় দিয়ে আল্লাহর জিকির করা হবে!

দোয়া ও মোনাজাত

রমজান মাসে দোয়ার মর্যাদা সুউচ্চ ও গুরুত্ব অপরিসীম; যখন রাতে বান্দা নির্জনে তার রবকে স্মরণ করে- এমতাবস্থায়, তখন রাত স্থবিরতায় নিস্তব্ধ হয়, পর্দা ঝুলিয়ে দেয় এবং গভীর অন্ধকার নেমে আসে; সে সময় তার জিহ্বা বলে ওঠে— তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে, যার কাছে আমি প্রত্যাশা করতে পারি ও আশ্রয় নিতে পারি?! আমি তোমার কাছে অগণিত ভূল-ত্রুটি ও পাপ নিয়ে হাজির হয়েছি; কাজেই আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমার ওপর দয়া করো এবং আমার অন্তরকে আলোকিত করো!

দান-সদকা

দানের মাধ্যমে আল্লাহর ধন-ভান্ডার কখনোই নিঃশেষ হয় না। তিনি প্রবাহিত প্রতিটি অশ্রুর ফোঁটা অবলোকন করেন, আপনার দুঃখ ও হূদয়ের যন্ত্রণা অবগত আছেন, আপনার বেদনা পর্যবেক্ষণ করে থাকেন, তিনি আপনার প্রার্থনা ও মিনতি শোনেন; বরং, তিনি দোয়ায় কাকুতি-মিনতিকারী বান্দাকে পছন্দ করেন, তাকে ডাকলে তিনি কখনোই ক্লান্ত হন না; বরং অনেক খুশি হন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (তখন বলে দিন যে) নিশ্চয় আমি অতি নিকটে। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে আমি তার আহ্বানে সাড়া দেই। কাজেই তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক, তারা সঠিক পথে চলতে পারে।’ (সুরা আল-বাকারা: ১৮৬)

রমজান মাসে যেন শোকাহতদের আর্তনাদে সাড়া দিতে, নিপীড়িতদের সাহায্য করতে, অসহায়দের ত্রাণ দিতে এবং মুসলমানদের বেদনা অনুভব করতে অন্তরসমূহ আকুল হয়ে থাকে। আর এটি আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়ার একটি উজ্জল চিত্র, ঈমানী ভ্রাতৃত্বের অধিকারসমূহের একটি মৌলিক অধিকার এবং আসমানে যিনি আছেন তাঁর রহমত আনয়নকারী। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রহমতকারীদের ওপর রাহমান তথা আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা জমিনবাসীদের ওপর রহম কর, তাহলে আসমানের অধিপতি আল্লাহ তোমাদের ওপর রহম করবেন।’ (সুনান আবু দাউদ)

আল্লাহর দিকে আপনার অগ্রগামিতার একমাত্র ফলাফল যদি এই হয় যে, তিনিও আপনার দিকে অগ্রসর হন, তবে এটিই যথেষ্ট। আর এই বাক্যের মাঝে এমন মর্ম নিহিত রয়েছে যা কোনো ব্যাখ্যায় পূর্ণতা পাবে না এবং কোনো শব্দমালা তা বর্ণনা করতে পারবে না। তাহলে কেমন হবে রমজানে যখন আল্লাহ আপনার দিকে এগিয়ে আসবেন?! তিনি আপনাকে গ্রহণ করেন তাঁর বদান্যতা, উদারতা, দান, অনুগ্রহ, করুণা, দয়া ও ক্ষমাসহ; যিনি সৎকর্মের প্রতিদান দেন সমপরিমাণ নেকি এবং আরও বেশি দিয়ে, নৈকট্যের বিনিময় দেন অধিক নিকটবর্তী হয়ে এবং অগ্রগামিতার বিনিময় দেন অধিক কবুলিয়্যাত দিয়ে।

বেশি বেশি নফল আমল করা

মুসলিমে এসেছে, আবুজর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি একটি নেক কাজ করবে তার জন্য রয়েছে দশগুণ সওয়াব; আর আমি তাকে আরও বাড়িয়ে দেব। আর যে ব্যক্তি একটি মন্দ কাজ করবে তার প্রতিফল সেই কাজের অনুরূপ হবে, কিংবা আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। আর যে ব্যক্তি আমার দিকে এক বিঘত পরিমাণ অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে এক হাত পরিমাণ অগ্রসর হই। যে আমার দিকে এক হাত পরিমাণ অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে দুই হাত পরিমাণ অগ্রসর হই। আর সে যখন আমার দিকে হেঁটে অগ্রসর হয়, আমি তখন তার দিকে দৌড়ে অগ্রসর হই।’

যখন আল্লাহ বান্দার অভিমুখী হন তখন তাকে ভালোবাসেন, আর যখন তাকে ভালোবাসেন তখন তাকে কবুল করে নেন এবং তাকে আসমানে ও জমিনে মকবুল বান্দাতে পরিণত করেন, তার হূদয়কে জীবিত রাখেন, মর্যাদাকে সমুন্নত করেন, খ্যাতি বৃদ্ধি করেন, পাপ মোচন করেন, প্রচেষ্টায় সহায়তা করেন, দোয়া করলে কবুল করেন এবং তার সকল বিপদাপদে তিনি যথেষ্ট হয়ে যান। আল্লাহর অভিমুখী হওয়ার মমার্থ যদি জানতে চান তাহলে এই হাদিসটি অনুধাবন করুন; ইমাম বুখারি আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোনো ওলির সঙ্গে শত্রুতা রাখে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দিলাম।

আমার বান্দা আমি যা তার ওপর ফরজ করেছি সেই ইবাদতের চাইতে আমার কাছে অধিক প্রিয় কোনো ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করবে না। আর আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারাও আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে; এমনকি অবশেষে আমি তাকে এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমি তার কান হয়ে যাই যা দিয়ে সে শুনে।

আমি তার চোখ হয়ে যাই যা দিয়ে সে সব কিছু দেখে। আর আমি তার হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাই যার দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কোনো কিছু চায়, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায়, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি যে কোনো কাজ করতে চাইলে এটাতে কোনো রকম দ্বিধা সংকোচ করি না- যতটা দ্বিধা সংকোচ করি মুমিন বান্দার প্রাণ হরণে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে, আর আমি তার কষ্ট অপছন্দ করি।’

৮ মার্চ মদিনার মসজিদে নববিতে দেয়া

খুতবার অনুবাদ

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ