সোমবার, ১৭ জুন ২০২৪, ৩ আষাঢ় ১৪৩১

নেপথ্যের কুশীলবদের শনাক্তের চেষ্টা

প্রকাশনার সময়: ২৭ মে ২০২৪, ০৮:১৬

রাতে খুন হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার কিলিং মিশনে আরো কারা জড়িত সেটা জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। তার দুই ফ্ল্যাটের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তাদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। বিশ্লেষণ করা হচ্ছে শাহীনের সিডিআর। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শাহীনের বাংলাদেশী ও বিদেশী একাধিক নম্বর ররেছে। তিনি এসব নম্বর থেকে কিলিং মিশন বাস্তবায়নকারী শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ সাঈদ, সেলে নিক্সি ওরফে সিলেস্তি রহমানসহ সংশ্লিষ্টরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

শাহীন ও শিমুলের বাংলাদেশী নম্বরের সিডিআর সংগ্রহ করে সেগুলোর বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। সিডিআর বিশ্লেষণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। কিলিং মিশনে অংশ নেয়া কুখ্যাত চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ, ভাড়াটে কিলার সিয়াম, জিহাদ, ফয়সাল ওরফে তানভীর ও মোস্তাফিজুর রহমান ফকির ও সেলে নিস্কি পরস্পরের মধ্যে বিশেষ অ্যাপসে যোগাযোগ করার তথ্য মিলেছে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া কষাই জিহাদকে সঙ্গে দিয়ে আনারের লাশের অংশ বিশেষের খোঁজে তল্লাশি অব্যাহত রেখেছে সেখানকার পুলিশ।

জিহাদকে নিয়েই তল্লাশীকালে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী ভাঙরের কৃষ্ণমাটি এলাকার বাগজোলা খাল থেকে পচা-দুর্গন্ধযুক্ত একটি ব্যাগ উদ্ধার করেছে সিআইডি। ব্যাগটির ভেতরে এমপি আনারের মরদেহের খণ্ডিত অংশ রয়েছে কিনা তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সেটি পরীক্ষা করে দেখছেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা। কষাই জিহাদ ওরফে জুবেরকে পুলিশের জেরায় জানিয়েছে মরদেহের খণ্ডিত অংশ জিরেনগাছা ও কৃষ্ণমাটি সেতুর কাছে বাগজোলা খালে ফেলা হয়েছিল।

শাহীনকে ফেরাতে যৌথভাবে কাজ চলছে: আনার হত্যা মামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড শাহীনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনতে যৌথভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ। পশ্চিমবঙ্গের সিআইডির কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি নেই; কিন্তু ভারতের আছে। আমরা শাহীনকে ভারতে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছি। কারণ অপরাধটি আমাদের রাজ্যে ঘটেছে।

এক রাষ্ট্রের নাগরিক অন্য দেশে কোনো অপরাধে জড়িত হলে বন্দি বিনিময় প্রক্রিয়ায় সেই দেশটি ওই ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনতে যে দেশে আত্মগোপন করেছে তাদের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন করতে পারে। ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদও বলেন, শাহীনকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ আমাদের কাছে যে সহযোগিতা চাইবে আমরা সেটা করব।

শাহীনকে ফেরত আনার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান রোববার সাংবাদিকদের জানান, শাহীনকে পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত, নেপাল, ইন্টারপোল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করছে। ভারতীয় সংবাদসংস্থা পিটিআইর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, শাহীন মূল সন্দেহভাজন এবং পলাতক। তাকে ফিরিয়ে আনতে একটি প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ চলছে। তার পরিবারের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ইন্টারপোলসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।’

প্রসঙ্গত, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যান ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। এরপর ১৬ মে থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন তিনি। পরে ১৮ মে থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন সংসদ সদস্যের পরিচিত ভারতের বরানগরের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাস। এরপর আনারের খোঁজে তল্লাশী শুরু করে কলকাতা পুলিশ। গত ২০ মে কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে আনারকে হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করার তথ্য জানায় ভারতীয় পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া ঘাতকদের স্বীকারোক্তি থেকে জানা গেছে, ১৩ মে দুপুরেই আনারকে হত্যা করা হয়েছে। শাহীনের পরিকল্পনায় হত্যাকাণ্ডে ছুরি, চাপাতি, দড়ি ও ট্রলি কিনে আনেন শিমুল ওরফে আমানুল্লাহ।

লাশ গুম করতে সিয়াম ভাড়া করেন কষাই জিহাদকে। সিয়াম গত ফেব্রুয়ারি থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজারহাটে শাহীনের ভাড়া করা অপর একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। সিয়াম, শিমুল ও জিহাদ মিলে আনারের লাশ ৮০ টুকরো করে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয়। মূল ঘাতক শাহীন ৩০ এপ্রিল শিমুল ওরফে আমানুল্লাহ, সেলে নিস্কিকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যান। সেখানে ১০ মে পর্যন্ত অবস্থান করে বাংলাদেশে আসেন। গুলশানের ফ্ল্যাটে অবস্থান করে কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করান এবং ২০ মে তিনি ভিস্তা এয়ার লাইন্সের একটি ফ্লাইটে করে বাংলাদেশ ছেড়ে কাঠমুন্ডু, দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।

আনার হত্যায় জড়িত সন্দেহে ঢাকার ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ৩ জন ৮ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গতকাল ছিল রিমান্ডের দ্বিতীয় দিন। অপর দিকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া মুম্বাইয়ের কষাই জিহাদ ১২ দিনের রিমান্ডে আছে। কিলিং মিশনে সরাসরি জড়িত সিয়ামকে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁও এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, কষাই জিহাদকে গ্রেপ্তারের পর হত্যকাণ্ডের পর কিভাবে এমপি আনারের মরদেহ টুকরো করে বিভিন্ন স্থানে ফেলেছে তার বর্ণনা দিয়েছে জিহাদ। তার তথ্যে পশ্চিমবঙ্গের পোলারটেক থাকার ভাঙর এলাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তল্লাশী চালিয়ে মরদেহের খোঁজ মেলেনি। আদৌ মরদেহের অংশ উদ্ধার হবে কিনা তা নিয়ে অশ্চিয়তা রয়েছে। তবে সিআইডি কর্মকর্তারা এখনো হাল ছাড়েননি। নানাভাবে চেষ্টা চলছে আনারের মরদেহের মাথাসহ টুকরো অংশ উদ্ধারের।

এদিকে আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবির ৩ তদস্যের প্রতিনিধ দল রোববার কলকাতায় পৌঁছান। ডিবির টিম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার জিহাদ হাওলাদারসহ সন্দেহভাজন আটক হওয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ডিবির টিম পশ্চিমবঙ্গের সিআইডিসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে মামলার তদন্তের অগ্রগতি এবং হত্যকাণ্ডের কারণ জানতে মিটিং করেন। দু’দেশের পুলিশ কর্মকর্তারা এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এবং মামলার ভবিষৎ কি হবে সে বিষয়েও পর্যালোচনা করেন।

বিমানবন্দরের ফটকে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে ডিবি প্রধান জানান, ‘বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় সংসদ সদস্য আনারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বিদেশের মাটিতে কোথাও ফেলে দেয়া হয়েছে। এ হত্যার মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামানসহ যারা হত্যাকারী সবাই বাংলাদেশী। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে তাদের মধ্যে ৩৬৪ ধারায় অপহরণের মামলা রুজু হয়েছে। এ মামলা অনুযায়ী বাংলাদেশে খুনের পরিকল্পনা হয়েছে এবং কলকাতায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়েছে। এমপি আনারের লাশ গুম করার জন্য লাশের টুকরো কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেয়া হয়েছে, যাতে করে এর আলামাতের অস্তিত্ব না থাকে। ডিবি প্রধান বলেন, আমাদের কাজ হচ্ছে অপরাধ যেখান থেকে শুরু হয়েছে এবং যেখানে শেষ হয়েছে— ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অনুযায়ী তদন্তকারী দলকে দু’টি স্থানেই পরিদর্শন করতে হয়।’

পশ্চিমবঙ্গে ডিবির টিম: আনার হত্যাকাণ্ডের তদন্তে গতকাল সকালে ডিবি পুলিশের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছেছে। দলের নেতৃত্বে আছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন উপকমিশনার আব্দুল আহাদ ও অতিরিক্ত উপকমিশনার সাহিদুজ্জামান।

কলকাতায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গে খুন হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের প্রতিনিধি দল আমাদের ওখানে গিয়েছেন। গ্রেপ্তার আসামীদের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলেছেন। আমরাও পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া আসামীদের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলার অনুমতি চাইব। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলসহ প্রয়োজনীয় জায়গাগুলো দেখব। তিনি আরও বলেন, কলকাতায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামীর সঙ্গে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হওয়া আসামীদের মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে আমরা আসামীকে নেয়ার অনুমতি চাইব। এছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদেরকে ভিডিও কলে মুখোমুখি করার চেষ্টা করব। রোববার বিকালে ডিবির প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেছেন। তারা সেখানকার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। হারুন আরও বলেন, ‘পূর্ববঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শিমুল বিশ্বাস তিনি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূল কাজ করেছেন, আমানুল্লাহ নামেই তিনি ভারতে এসেছেন। বাংলাদেশে গ্রেফতার হওয়ার পর তার কাছ থেকে অনেক তথ্য পেয়েছি আমরা। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ এবং বাংলাদেশের পুলিশের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে বিস্তর সমন্বয় হয়েছে এবং আগামীতে আরো হবে।

ডিবি প্রধান বলেন, আমরা কলকাতা পুলিশের কাছে এ ব্যাপারে সহযোগিতা চাইব। বলতে গেলে তারা ইতোমধ্যে আমাদের প্রচুর সহযোগিতা করেছে এবং করছে। মোট কথা পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে এ খুনের পিছনের মূল কারণ কি রয়েছে তা খুঁজে বের করা সম্ভব হবে বলেও মনে করেন তিনি। তাছাড়া সিআইডি’র উচ্চতর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের যোগাযোগ হচ্ছে। ভারতের পুলিশ বাংলাদেশে গিয়ে আসামীদের সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা বলেছে। আমরা সিআইডির কাছে অনুমতি চাইব এখানে গ্রেপ্তারকৃত অভিযুক্তর সঙ্গে কথা বলে তথ্য যাচাই-বাছাই করতে। তবে আমার জানা মতে এখনো লাশ উদ্ধার হয়নি।’

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ