মঙ্গলবার, ১৮ জুন ২০২৪, ৪ আষাঢ় ১৪৩১

আঘাত হেনেছে ‘রেমাল’

প্রকাশনার সময়: ২৭ মে ২০২৪, ০৮:০৭ | আপডেট: ২৭ মে ২০২৪, ০৮:১৪

ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাত হেনেছে। আবহাওয়াবিদ শামীম হাসান ভূইয়া গতকাল রোববার রাত সোয়া ৮টায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান। রেমালের তাণ্ডবে উপকূলীয় জেলাগুলোর মানুষের রাত কেটেছে নির্ঘুম ও আতঙ্কে।

আবহাওয়াবিদ শামীম জানান, প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল রোববার সন্ধ্যা ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৩১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। তিনি বলেন, ‘প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের কেন্দ্র মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করেছে। আরো উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম করে সম্পূর্ণ ঘূর্ণিঝড়টি পরবর্তী ৫ থেকে ৭ ঘণ্টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।’ ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ছিল ৯০ কিলোমিটার; যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।

আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রভাগ রোববার দুপুরেই উপকূল স্পর্শ করেছিল। সন্ধ্যা ৬টার পর এর কেন্দ্রভাগ উপকূলে উঠে আসতে শুরু করে। মোংলা ও পায়রা বন্দরকে আগের মতোই ১০ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় আছে। আর উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় আছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার নদী বন্দরগুলোকে ৪ নম্বর নৌ-মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়া অফিস বলছে, প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপের পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮-১২ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ ভারি (৪৪-৮৮ মিলিমিটার/২৪ ঘণ্টা) থেকে অতি ভারি (২৪ ঘণ্টায় ৮৯ মিলিমিটারের বেশি) বর্ষণ হতে পারে।

অতি ভারি বর্ষণের প্রভাবে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধস হতে পারে বলেও সতর্ক করেছে আবহাওয়া অফিস। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সারা দেশে নৌচলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কক্সবাজার বিমানবন্দর ও বরিশাল বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সব ধরনের কাজ বন্ধ। বন্দরের জেটি থেকে সব জাহাজকে পাঠানো হচ্ছে সাগরে। উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৮ হাজার ৪৬৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত; আশ্রয় নিয়েছেন ৫২ হাজার ৪৪৬ জন। উপকূলীয় জেলায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডব থেকে দুর্যোগকবলিত এলাকার মানুষকে বাঁচাতে আট থেকে নয় হাজার আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মুহিবুর রহমান। রোববার দুপুরে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক শেষে তিনি বলেন, ঝড় মোকাবিলার পরে রেসকিউ করার জন্য টিমগুলো প্রস্তুত রয়েছে, আমাদের সেনাবাহিনীর টিম প্রস্তুত রয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধস মোকাবিলা করার জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনীর লোকজন সমস্ত সরঞ্জামাদি নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে। এককথায় আমরা আরও সক্ষমতার সঙ্গে প্রস্তুত রয়েছি।

কালক্ষেপণ না করে সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। ৮-৯ হাজার নিরাপদ আশ্রয়স্থল প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি ঝড় মোকাবিলার পরে রেসকিউ করার জন্য টিম প্রস্তুত রয়েছে।

আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করার পাশাপাশি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে শুকনো খাবার। ঝড়ের পরের উদ্ধার তৎপরতার জন্য মেডিকেল টিম ও স্বেচ্ছাসেবকরা প্রস্তুত আছেন।

যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে ফায়ার সার্ভিসের নিকটবর্তী ফায়ার স্টেশন, বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হটলাইন নম্বর ১৬১৬৩ অথবা কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলের জরুরি মোবাইল নম্বর ০১৭৩০৩৩৬৬৯৯-এ ফোন করার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছে। ব্যুরো ও প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর—

পটুয়াখালীতে এক জনের মৃত্যু : পটুয়াখালীতে ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বোন ও ফুফুকে নিরাপদ রাখার জন্য আশ্রয় কেন্দ্রে আনতে গিয়ে পানির তোড়ে ভেসে মারা গেছেন এক যুবক। রোববার দুপুরে কলাপাড়া উপজেলার ধূলাসর ইউনিয়নের কাউয়ারচর এলাকায় তলিয়ে যাওয়া সড়ক সাঁতার কেটে পার হতে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ২৮ বছরের শরীফ হাওলাদার ওই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের অনন্তপাড়া এলাকার আবদুর রহিম হাওলাদারের ছেলে।

সুন্দরবনের নদী ফুলে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত : ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে অতি জোয়ারে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে; এতে বনের প্রাণীর প্রাণহানীর আশঙ্কা করছে বনবিভাগ। রোববার উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের প্রধান প্রধান নদ-নদী বিপৎসীমার উপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহিত হচ্ছে বলে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল-বিরুণী জানান। তিনি বলেন, নদ-নদীর পানি দুই থেকে পাঁচ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে বনের মিষ্টি পানির আধার শতাধিক পুকুর তলিয়ে গেছে। ফলে প্রাণিকূল ও বনকর্মীদের বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট তৈরি হতে পারে।

সুন্দরবনের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বিকালে বলেন, রেমাল ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ঝড়ের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে পানির অস্বাভাবিক চাপ রয়েছে। রোববার দুপুরের জোয়ারের পানি সুন্দরবনের সব নদ-নদীতে প্রবাহিত হয়। সেই পানির উচ্চতা ছিল পাঁচ থেকে আট ফুট পর্যন্ত। “সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। বনের হরিণ, বানর, রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বিভিন্ন প্রজাতির আবাসস্থল তলিয়ে যাওয়ায় প্রাণিকূলের প্রাণহানির শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।” মিহির কুমার বলেন, “বনের মিষ্টি পানির একমাত্র আধার শতাধিক পুকুর তলিয়ে গেছে। বনকর্মী ও প্রাণিকূল ওই পুকুরের পানি পান করে থাকে। এতে করে মিষ্টি পানির একটা সংকট তৈরি হবে। দুর্যোগ চলে যাওয়ার পর প্রাণিকূলসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।”

ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে ঘুম ছুটেছে খুলনাবাসীর : দক্ষিণের উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ বেড়িবাঁধই দুর্বল। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা, কয়রার ৬৩০ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। আর সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর আওতায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৩৮০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। বারবার বাঁধ ভাঙ্গায় দুর্যোগের সংকেত পেলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে উপকূলবাসী।

খুলনার ও সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। আইলার সেই ক্ষত কাটিয়ে ওঠার আগেই ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৪ মে ফণী এবং ওই বছরের ১০ নভেম্বর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। এ ছাড়াও ২০২০ সালের ২০ মে আম্ফান, ২০২১ সালের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস, ২০২২ সালের ১২ মে আসনি, এরপর ওই বছরের ২৫ অক্টোবর সিত্রাং এবং সর্বশেষ ‘মোখা’ আঘাত হানে। এসব ঘূর্ণিঝড়ের সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় কয়রা, দাকোপ, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন যার ক্ষত এখনো শুকায়নি। এবার উপকূলের আতঙ্ক ঘূর্ণিঝড় রেমাল। এরই মধ্যে উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের অনেক জায়গা দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি ঢুকছে বলে জানা গেছে।

শনিবার গভীর রাতে সুভদ্রাকাটি এলাকার একটি জরাজীর্ণ বাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করে এলাকাবাসী। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সেখানে জিও ব্যাগের ব্যবস্থা করা হয়। আর এলাকাবাসী জিও ব্যাগে মাটি ভরে রাস্তা সংস্কার করে। যে কোনো সময় দুর্বল বেড়িবাঁধ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে প্লাবিত হতে পারে বিস্তীর্ণ এলাকা— এমন আশঙ্কায় ঘুম ছুটেছে খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা; সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনির এবং বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকার মানুষের।

কয়রা উপজেলার গোবরা গ্রামের বাঁধের পাশে বসবাসকারী আখতারুজ্জামান ও বিল্লাল হোসেন জানান, আইলার সময় ঘাঁটাখালি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় তাদের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়। এরপর প্রায় দুই মাস আশ্রয় কেন্দ্রে থাকেন। সেখান থেকে বাঁধের উপরে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস শুরু করেন তারা। এক পর্যায়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কথায় বাঁধের স্লোবে পুনরায় ঘর তৈরি করে বসবাস করেছেন।

আইলার ১৫ বছর পরও তারা নিজ ঠিকানায় ফিরতে পারেননি। সেখানে বাঁধের পাশে প্রায় শতাধিক পরিবার রয়েছে। তারা রিমালের সতর্ক সংকেত পেয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আছের আলী মোড়ল জানান, তার ইউনিয়নের ঘড়িলাল থেকে চরামুখা খেয়াঘাট ও খেয়াঘাট থেকে হলদিবুনিয়া পর্যন্ত এলাকার বেড়িবাঁধ বেশি ঝুঁর্কিপূর্ণ।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের আওতায় ৩৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। তবে গাবুরায় মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। ‘কিছু জায়গায় সমস্যা রয়েছে। তাৎক্ষণিক কোনো সমস্যা হলে সেজন্য কাজ করার সুযোগ রয়েছে।’

খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিভাগ-২) এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমার এরিয়ার মধ্যে ৬৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ১০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া তাৎক্ষণিক কোনো সমস্যা হলে জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।

খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য ৬০৪টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব সাইক্লোন শেল্টারে মোট ৩ লাখ ১৫ হাজার ১৮০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এছাড়া ৩টি মুজিব কিল্লায় ৪৩০ জন মানুষের পাশাপাশি ৫৬০টি গবাদি পশু রাখার ব্যবস্থা রয়েছে।

কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলায় ৫ হাজার ২৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।

১৬ জেলায় ৮ থেকে ১২ ফুট জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা : প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়া রেমালের প্রভাবে দেশের ১৬ জেলায় ৮ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঘূর্ণিঝড় রেমাল নিয়ে ১১ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের প্রায় প্রতিটি বিভাগে বৃষ্টিও হতে পারে বলে জানানো হয়েছে। পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টির সামনের অংশ ও বায়ুচাপের পার্থক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং এসব জেলার কাছের দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে।

প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার। এটি দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছের এলাকায় সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে।

৫ জেলায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে দেশের সব বিভাগে দমকা হাওয়াসহ ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সেই সঙ্গে অতিবৃষ্টির কারণে ভূমিধসের আশঙ্কার কথাও বলা হয়েছে। রোববার ঘূর্ণিঝড় রেমাল নিয়ে ১১ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে অতি ভারী বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধস হতে পারে।

সব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল: ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। ধারণা করা হচ্ছে, রাতের মধ্যে চূড়ান্ত আঘাত হানতে পারে ঝড়টি। এ দুর্যোগ মোকাবিলায় উপকূলীয়দের পাশে থাকার জন্য সব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। রোববার সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটির সভা শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এরই মধ্যে ৮ লাখের বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন। বাকিদের আসার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে আপাতত স্কুল খোলা থাকবে, তবে ক্লাস বন্ধ থাকবে।

উপকূল থেকে ২৯৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল, যা আরও অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। যার ফলে দেশের সমুদ্রবন্দর ও উপকূলীয় জেলাগুলোতে সতর্ক সংকেত দেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সব কার্যক্রম বন্ধ: ঘূর্ণিঝড় রেমাল এগিয়ে আসায় চট্টগ্রাম বন্দরে নিজস্ব সতর্কতা সংকেত অ্যালার্ট-৪ জারি করে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক রোববার সকালে বলেন, আবহাওয়া অফিস ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারির পর বন্দরের সর্বোচ্চ সতর্ক সংকেত অ্যালার্ট-৪ জারি করা হয়েছে। “সতর্কতার অংশ হিসেবে জেটিতে থাকা ১৩টি জাহাজকে ইতোমধ্যে বহির্নোঙরে পাঠানো হয়েছে। যেগুলো বাকি আছে, সেগুলোও চলে যাচ্ছে।” বন্দর সচিব জানান, জাহাজ থেকে পণ্য ওঠা-নামা এবং খালাস বন্ধ। ভারী যন্ত্রপাতি নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে জরুরি সভায় বসছে কর্তৃপক্ষ। বন্দর কর্তৃপক্ষের নেয়া ঘূর্ণিঝড়-দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং পরবর্তী পুনর্বাসন পরিকল্পনা অনুযায়ী আবহাওয়া অধিদপ্তর ৩ নম্বর সংকেত জারি করলে প্রথম পর্যায়ের সতর্কতা অ্যালার্ট-১ জারি করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

আবহাওয়া অধিদপ্তর ৪ নম্বর সংকেত জারি করলে বন্দর অ্যালার্ট-২ জারি করে। বিপদ সংকেত ৫, ৬ ও ৭ নম্বরের জন্য বন্দরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সতর্কতা অ্যালার্ট-৩ জারি করা হয়। বিপদ সংকেত ৮, ৯ ও ১০ হলে বন্দরে সর্বোচ্চ সতর্কতা বা অ্যালার্ট-৪ জারি করা হয়। এর আগে শনিবার রাতে অ্যালার্ট-৩ জারি করা হলে তখনই বন্দরের জেটিতে সব অর্ধসমাপ্ত কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশনা দেয়া হয়। পাশাপাশি জেটি থেকে জাহাজ সরাতে বলা হয়। কিন্তু রাতে জোয়ার না থাকায় রোববার সকালে জেটি থেকে জাহাজ সাগরে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু হয়।

জাহাজশূন্য চট্টগ্রাম বন্দর: উপকূলের দিকে ক্রমশ অগ্রসর হওয়া ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতের আশঙ্কায় চট্টগ্রাম বন্দরে ‘অ্যালার্ট-থ্রি’ অর্থাৎ বিপৎসংকেত জারি করা হয়েছে। বন্দরের জেটিতে অবস্থানরত সব জাহাজকে গভীর সাগরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলা হয়েছে। এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতের আশঙ্কায় চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি থেকে ১৬টি জাহাজ সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বহির্নোঙ্গর থেকে ৪৯টি জাহাজকে গভীর সমুদ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। জেটি থেকে সর্বশেষ কনটেইনার পরিবহন চলছিল, সেটাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আসা-যাওয়া, কনটেইনারসহ পণ্য ওঠানামা ও খালাসসহ সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

নয়াশতাব্দী/ জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ