ঢাকা, রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ২ আষাঢ় ১৪৩১, ৯ জিলহজ ১৪৪৫

ভারতে খুন এমপি আনার

প্রকাশনার সময়: ২৩ মে ২০২৪, ০৭:০৫

চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার খুন হয়েছেন। কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে তার রক্তমাখা জামা পাওয়া গেলেও মরহেদ উদ্ধার করা যায়নি। গোয়েন্দারা বলছেন হত্যার পর আনারের লাশ কয়েক খণ্ড করে গুম করা হয়েছে। আনার খুনের নেপথ্যে স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসার বিরোধসহ নানা কারণ খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা। তারা বলছেন, কিলিং মিশনে অংশ নিয়েছিল এক নারীসহ ৬ জন। তাদের মধ্যে সৈয়দ আমানুল্লাহ সাঈদ, নিস্কি রহমান ও জাহিদ নামে তিনজনকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) আটক করেছে। কলকাতা পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের পর তাদের আটক করা হয়। তবে অপর একটি সূত্র দাবি করেছে এ ঘটনায় আটক মারুফ, মোকারম ও সিনথীয়া নামের আরও তিনজনকে আজ গ্রেফতার দেখানো হতে পারে। পাশাপাশি আরও কয়েকজনকে আটকের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। এছাড়া কলকাতা পুলিশও ২ জনকে আটক করেছেন। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে পরিকল্পনাকারী হিসেবেও পাওয়া গেছে নানা বক্তব্য। কেউ বলছেন, ঢাকার গুলশানের একজন ডায়মন্ড ব্যবসায়ী ও একজন ডেভেলপার ব্যবসায়ী এবং ঝিনাইদহের স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি খুনের পরিকল্পনায় জড়িত। পাশাপাশি ওই এলাকার প্রভাবশালি শাহীন নামের একজন প্রতিনিধির সম্পৃক্ততা এখন অনেকটাই স্পষ্ট। তাদের শনাক্ত করতে পুলিশ কাজ করছে। খুনের পরিকল্পনা হয়েছে ঢাকার অভিজাত এলাকার একটি ফ্ল্যাটে। কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করতে এক নারী মডেলকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে গোয়েন্দারা ধারণা করেছেন।

এদিকে এমপি আনারের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন পরিকল্পিতভাবে এমপি আনারকে খুন করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেছেন, খুনের মূলহোতা পুলিশের হেফাজতে আছেন। আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বলেন, ‘আমি আমার বাবার হত্যাকারীদের বিচার দেখে যেতে চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই আমার বাবার হত্যাকারীদের বিচারের ব্যবস্থা করবেন।’ এ ঘটনায় হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে শের-ই-বাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া ভারতের নিউটাউন থানায় একটি খুনের মামলা হয়েছে বলে একটি সূত্র দাবি করেছে।

প্রসঙ্গত: গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ভারতে যান এমপি আনার। সেখানে ১৪ মে থেকে তার সঙ্গে পরিবার বা অন্য কেউ যোগাযোগ করতে পারেনি। ২১ মে তিনি মারা গেছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল কলকাতার পুলিশ জানায় তিনি নিউটাউন থানা এলাকার একটি অভিজাত ফ্ল্যাটে খুন হয়েছেন। সেই ফ্ল্যাটে রক্তের দাগ মিলেছে। সেখান থেকে ফিঙ্গার প্রিন্টসহ ফরেনসিক নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। বাংলাদেশি এক ব্যক্তির ভাড়া নেয়া ওই ফ্ল্যাটটিতে পুলিশ অস্থায়ী ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে রেখেছে। বাড়িতে প্রবেশ ও বেরোনোর ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, আনার হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় মাত্র ২০ মিনিটে। নিউটাউনের ওই ফ্লাটের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এমনটাই দাবি করেছেন গোয়েন্দারা। কিলিং মিশনের মূল নেতৃত্ব ছিল ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের এক জনপ্রতিনিধির ভাই। তার সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে যশোরের শাহীন নামে এক প্রভাবশালি জনপ্রতিনিধিরও। এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় ৫ জন। এ জনপ্রতিনিধির ভাই আনারের বাল্যবন্ধু ছিল। হত্যার পর আনারের মরদেহ টুকরো করে শরীরের বিভিন্ন অংশ ৪টি ট্রাভেল ট্রলিতে ডুকিয়ে নেয়। ডিবির হাতে আটক হওয়া আমানুল্লাসহ সম্পৃক্তদের স্বীকারোক্তি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে বলে সূত্র দাবি করেছে। মূলত হুন্ডির বিশাল অঙ্কের একটি টাকা মেরে দেয়ায় আনারের ওপর ক্ষোভ ছিল যশোরের গডফাদার হিসাবে খ্যাত ওই জনপ্রতিনিধির।

সূত্রমতে, আনার নিখোঁজ হওয়ার পর তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবি পুলিশের ওয়ারি বিভাগ। ডিবির ওয়ারি বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) সহিদুজ্জামান সাহেদের নেতৃত্বাধীন একটি টিম কাজ করেন। তারা আনার হত্যায় জড়িত সন্দেহে ৩ জনকে আটক করেছে। আটকৃতরা গোয়েন্দাদের চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে সূত্র দাবি করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির ওয়ারি বিভাগের ডিসি আব্দুল আহাদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। সব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।

পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে মোবাইল লোকেশন

সূত্রমতে, এমপি আনারকে হত্যার পর তার মোবাইল নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয় খুনিরা। তারা ওইসব মোবাইল থেকে বিভিন্নজনকে মেসেজ পাঠাতে তাকে। একটি মেসেজে ছিল এমপি আনার দিল্লিতে অবস্থান করছে, তাকে কেউ যেন বিরক্ত না করে। এছাড়া এমপি আনারের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ আছে এমন কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার কাছেও মেসেজ দেয়া হয় তার মোবাইল থেকে। মূলত পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে হত্যাকারীরা এসব মেজেস দেয়।

খুনের নেপথ্যে যা যা রয়েছে

সূত্রমতে, আনার দীর্ঘদিন থেকে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট রেডনোটিশ জারি করে আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ২০০৭-০৮ সালের দিকে তিনি স্বর্ণ পাচারকারি চক্রের বিশাল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে। এ নিয়ে বাংলাদেশি ও ভারতীয় চক্রের মধ্যে চরম ক্ষোভ ছিল। সেই প্রতিশোধ নিতে তাকে টার্গেট করা হয়েছে। এছাড়া ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত স্বর্ণ এবং মাদক চোরাচালানের অন্যতম রুট। এ রুটের পাচারকারীদের কাছ থেকে নিয়মিত কমিশন নিতেন আনার। এসব নিয়ে পাচারকারীদের সঙ্গে তার বিরোধ দেখা দেয়। এছাড়া এমপি আনার মাদক, হুন্ডি ব্যবসা, অস্ত্র-বিস্ফোরক দ্রব্য, স্বর্ণ চোরাকারবারসহ নানা অপরাধে যুক্ত ছিল। এলাকায় ছিল তার একক আধিপত্য। এসব ক্ষোভ থেকে তাকে হত্যা করা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, ২০০৭ সালের দর্শনা এলাকার সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী সাইফুল হত্যা মামলার প্রতিশোধ নিতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটান হয়েছে।

সন্দেহে গোপাল বিশ্বাসও: এমপি আনার হত্যা মামলার সন্দেহভাজন হিসেবে তার বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের নামও এসেছে। গোপাল বিশ্বাস একসময় হতদরিদ্র ছিলেন। আনারের টাকায় তিনি জুয়েলারি ব্যবসা শুরু করেন। জুয়েলারি ব্যবসায় তার পাঁচতলা বাড়িসহ ব্যাপক উন্নতি হয়। ওই অর্থের সবই আনারের ছিল বলে ঝিনাইদহের স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে।

পরিকল্পিত হত্যার তথ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর: গতকাল দুপুরে এক ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, আনোয়ারুল আজিম আনারকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। খুনের ঘটনায় তিনজনকে আটক করা হয়েছে। আটকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। নেপথ্যের কারণ পরে জানাব। তিনি বলেন, আমরা সুনিশ্চিত তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় ভারতের কেউ জড়িত না। অনেক তথ্য আছে, তদন্তের স্বার্থে অনেক কিছুই বলা যাচ্ছে না। খুনের মোটিভ জানার কাজ চলছে। চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন, বাংলাদেশিরাই হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আইজিপি বললেন যৌথ তদন্ত চলছে: আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ভারতে গিয়ে নিখোঁজ এমপি আনারের মরদেহ উদ্ধারের খবর পেয়েছি গণমাধ্যম সূত্রে। তবে ইন্ডিয়ান বা কলকাতা পুলিশ আমাদের এখনো কিছু নিশ্চিত করেনি। তিনি জীবিত নাকি মৃত তা এখনো অফিসিয়ালি নিশ্চিত নই। আমরা যৌথভাবে তদন্ত কাজ করছি।

ডিবি প্রধান: গতকাল ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন আর রশীদ বলেন, এমপি আনার বাংলাদেশের কিছু অপরাধীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। এটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনা পারিবারিক, আর্থিক নাকি এলাকার কোনো দুর্বৃত্তকে দমন করার জন্য হয়েছে, তা আমরা তদন্ত করে দেখছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে কাজ করছি। এ ঘটনায় শের-এ-বাংলা নগর থানায় আজকের মধ্যে মামলা হবে।

তিনি জানান, আনোয়ারুল আজীম আনারের মেয়ে মামলা করতে সহযোগিতা ও পরামর্শের জন্য তাদের কাছে গিয়েছিলেন। মামলা করতে তার মেয়েকে সহযোগিতা করবে পুলিশ। কিলিং মিশনে অংশ নেয়া কয়েজনকে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। তদন্তের স্বার্থে আটক ব্যক্তিদের নাম বলা হচ্ছে না। বাকিদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

মামলা দায়ের: এদিকে ভারতের কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের হয়েছে। গতকাল বুধবার রাজধানী ঢাকার শের-এ-বাংলা নগর থানায় খুন করার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। সন্ধ্যায় শের-এ-বাংলা নগর থানায় মামলাটি নথিভুক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আহাদ আলী। তিনি বলেন, অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে (মামলা নম্বর ৪২)। এখন তদন্ত করে আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হকও মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, মূলত এমপি আনার সংসদ ভবন এলাকায় থাকতেন। সেখান থেকে তিনি ভারতে গেছেন। তাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) প্রধান হারুন-অর-রশিদের পরামর্শে শের-এ-বাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেন তার মেয়ে ডরিন। এদিকে ভারতের নিউটাউন থানায় একটি খুনের হয়েছে বলে একটি সূত্র দাবি করেছে।

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ