ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

পেশাগত উন্নয়ন নিশ্চিতে সাত উপায়

প্রকাশনার সময়: ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:৪৩

আপনি যে পেশাতেই থাকুন দক্ষতার বিকল্প নেই। দক্ষতা হুট করে আসবে না। এটা অর্জন করতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অবলম্বন করতে হবে। সেগুলো নিয়েই আজকের আলোচনা—

১. ভয়কে জয় করার মানসিকতা: নানা কারণে নানা সময় মানুষ ভয় পেয়ে থাকে। বিভিন্ন মানুষের ভয়ের কারণ আলাদা আলাদা। একজন ছাত্র পরীক্ষায় খারাপ ফল করার ভয় পায়, একজন ব্যবসায়ী ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ার ভয় পান, রাজনীতিবিদ ভোটে হেরে যাওয়ার ভয় পান, সিনেমার তারকা তার ছবি ফ্লপ হওয়ার ভয় পান। মানুষের প্রকৃতিই হলো নানা কারণে ভয় পাওয়া। কখনো ভূতের ভয়, কখনো অজানার ভয়, কখনো ব্যর্থতার ভয়, আবার কখনো প্রাণের ভয় মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এ ভয়ের বসবাস আর কোথাও নেই, শুধুই মানুষের মনে। আর এ ভয়ই মানুষের ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একবার যদি মন থেকে ভয় দূর করে ফেলা যায়, তাহলে কোনো কাজই আর মানুষের জন্য কঠিন নয়।

যে কোনো নতুন কাজ শুরু করার আগে সবাই ভয় পায়। কিন্তু ব্যর্থতার ভয় কখনো করা যাবে না বা কাজ কখনো অর্ধেক করে ছেড়ে দেয়া যাবে না। মন দিয়ে চেষ্টা করতে হবে, সাফল্য একদিন আসবেই। যে কাজটা করতে সবার ভয়, সেই কাজটা বারবার করতে হবে। এটাই হলো ভয়কে জয় করার সবচেয়ে সহজ উপায়। ভয়কে কখনো জীবনের কাছাকাছি আসতে দেয়া যাবে না। ভয় যদি কোনো কারণে কাছাকাছি চলে আসে, তবে এর ওপর আক্রমণ করতে হবে। অর্থাৎ ভয় থেকে পালিয়ে যাওয়া যাবে না, এর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে।

নিজের ভয়কে জয় করতে হলে অলস বসে থাকা যাবে না। তাহলেই সেই ভয়ের চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাবে। নিজের মনকে নানা কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। তাহলেই ভয় আর মনের মধ্যে আসতে পারবে না। যদি কারো মনে ভয় না লাগে, তার মানে এই নয় যে সে জিতে গেছে। যে বিষয়ে যার ভয়, তাকে জয় করাই হলো আসল সাহসের পরিচয়। বলা হয়ে থাকে, মনে ভয় না থাকলেই যে সেই ব্যক্তি সাহসী তা নয়, আসল সাহসী তিনি, যিনি নিজের ভয়কে জয় করেছেন।

২. বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা: বই পড়ার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে। বই পড়ার গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। আত্মোন্নয়নের জন্য বই পড়া জরুরি। বই পড়াকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে গড়ে তোলা উচিত। নিজেদের আত্মোন্নয়নের জন্য নিয়মিত বই পড়ার মাধ্যমে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

গতানুগতিক বইয়ের পাশাপাশি নিজের আত্মোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের বই পড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আত্মোন্নয়ন বই পড়লে একজন ব্যক্তির, চলাফেরা, আচার আচরণ উন্নত করা সম্ভব। আত্মোন্নয়নমূলক বই পড়ে মানসিক হীনম্মন্যতা, বিষণ্নতা ও বদঅভ্যাস ত্যাগ করে সুন্দর জীবন গঠন করে অধিকতর সাফল্য অর্জন করা যায়।

নতুন কিছু শিখতে বা জানতে গেলে পড়াশোনার বিকল্প কিছু হয় না। পড়াশোনা মানে শুধু যে বই খুলে বসে পড়া এমনটা নয়, যেটুকু সময় পড়বেন সেটুকু সময় পড়ার মতো করেই পড়তে হবে। এর জন্য এখন অনেক স্মার্ট পদ্ধতি চলে এসেছে যেমন ইউটিউব, অ্যাপস, অনলাইন মক টেস্ট, কুইজ কনটেস্ট, Quora ইত্যাদি আরও অনেক উপায় আছে যেখান থেকে প্রয়োজন মতো জ্ঞান সংগ্রহ করা যায়।

গতানুগতিক বই পড়ার মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে একজনের মনের অবস্থা সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু আত্মোন্নয়নমূলক বই পড়লে একজন লেখকের মনের গভীরে জানা যায়। পৃথিবীতে বিখ্যাত ব্যক্তিরা নিয়মিত বই পড়তেন। তাদের মধ্যে ইলন মাস্ক, বিল গেটস, হিলারি ক্লিন্টন, জেফ বেজোস, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেপোলিয়ন প্রমুখ অন্যতম।

৩. নতুন নতুন বিষয় জানার চেষ্টা করা: মনে একটু উৎসাহ আর সচেতনতা থাকলেই প্রতিদিন নতুন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে প্রতিদিন আশপাশে ও পৃথিবীতে কী ঘটছে সেটার বিষয়ে অবগত থাকা উত্তম। এজন্য রোজ খবরের কাগজ পড়া বা ইউটিউবে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ভিডিও দেখা ভালো। খবর পড়তে পড়তে দেখা যায় অনেক নতুন জিনিস উঠে আসছে, যেগুলোর ব্যাপারে আগে থেকে জানা থাকে না। যদি একদিন কিছু পড়তে ভালো নাই লাগে, তাহলে নতুন গান শুনুন, কবিতা শুনুন। শুনতে শুনতে শিখে ফেলুন।

সবচেয়ে ভালো হয় নিজে লেখার চেষ্টা করা। সময় পেলেই নতুন কোনো বিষয় উঠিয়ে নিয়ে তার সম্পর্কে অনুসন্ধান করা এবং সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ বা যে কোনো জায়গায় লেখালেখি করা। লিখলে জ্ঞান বাড়ে, নিজের কাছে নিজে পরিষ্কার হওয়া যায়। প্রতিনিয়ত যদি কিছু শিখতে হবে, নিজের কাজে মনোনিবেশ করলে দেখা যাবে পরনিন্দা বা পরচর্চা কিছু মনেই আসছে না। একটা কথা মনে রাখতে হবে, যত পরিশ্রম করবেন ততই জ্ঞান চক্রবৃদ্ধি সুদ আকারে বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং এর ফল হাতেনাতেই পাওয়া যাবে- যখন সময় ভালো চলবে।

৪. খোলা মনে কথা বলা: নমনীয় এবং খোলা মনের হওয়া ভালো। অনমনীয় (Rigid) মনোভাবের মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করা কঠিন ও অস্বস্তিকর। আরেকজনকে বোঝার চেষ্টা, পুরোপুরি বিপরীত মত দেখেও হুট করে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সেটা নিয়ে ভাবা ভালো অভ্যাস। এটা আপনার কমিউনিকেশন স্কিল বাড়াবে, সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাবে, জ্ঞান বাড়াবে, সর্বোপরি নিজের ব্যক্তিত্ব মজবুত করবে। এসব ক্ষেত্রে সৎ থাকুন। নিজের জানায় বা ধারণায় ভুল খুঁজে পেলে সংশোধন করে ফেলতে হবে। আখেরে নিজেরই লাভ বেশি। খোলা মনের মানুষ হতে গেলে প্রচুর সময় দিতে হবে মানুষের সঙ্গে। ছোট বড় সবার সঙ্গে মেশার কৌশলগুলো রপ্ত করতে হবে। যদিও সবার মন-মানসিকতা সমান হয় না; কিন্তু সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলার চেষ্টা করা উত্তম।

পরিবারের সদস্য, বন্ধু, সহকর্মী বা সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের ভালো বিষয়গুলোকে নিয়ে বা সাম্প্রতিক কোনো সাফল্য নিয়ে কথা বললে ভালো হয়। তাদের প্রশংসা করা, কৃতিত্ব দেয়া, উৎসাহিত করার চেষ্টা করা। ইতিবাচক মন্তব্যের পাশাপাশি কোনো বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনাও করা যেতে পারে, সে জায়গাগুলো থেকে বেরিয়ে আসার বা উন্নতি করার পথও দেখিয়ে দেয়া যেতে পারে। কিছু কিছু সময় নিজের কোনো বিষয়েও বাহির থেকে বা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকেও বিভিন্ন পরামর্শেরও প্রয়োজন হতে পারে।

৫. যোগাযোগ বা নেটওয়ার্ক বাড়িয়ে তোলা: নেটওয়ার্কিং, কোলাবরেশন ও যোগাযোগ নতুন চিন্তা, নতুন কর্মপন্থা এবং নতুন সুযোগ তৈরি করে। নেটওয়ার্ক উল্লেখযোগ্যভাবে যে কোনো ব্যক্তির সাফল্যকে প্রভাবিত করতে পারে। নিজেকে এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে রাখতে হবে যারা সব কিছুতেই অনুপ্রাণিত করতে পারে, সমর্থন করে এবং চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে সাহায্য করে। বিভিন্ন লোকের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে, নতুন ধারণা শিখতে পারা যায় এবং বুঝতে পারা যায় কিভাবে যোগাযোগ করতে হয় এবং কিভাবে বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কাজ করতে হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে দেখা করা যায় এবং এমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে যা ভবিষ্যতের জন্য সহায়ক হতে পারে। বিভিন্ন ইন্টারেস্ট গ্রুপের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা অথবা আগ্রহের বিষয়গুলোর সংক্রান্ত বিভিন্ন কনফারেন্স এবং ইভেন্টগুলোতে যোগ দেয়ার মাধ্যমে নেটওয়ার্কিং বাড়ে।

অবশ্যই নেটওয়ার্কিং হতে হবে সৎ ও উদ্দেশ্যবহুল। চাকরি খোঁজা বা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন রেফারেন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সব মানুষেরই সামর্থ্য রয়েছে এবং প্রত্যেকের নিজস্ব সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষতা রয়েছে। কিন্তু যথাযথ যোগাযোগের অভাবে আরও ভালো একটি সুযোগ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। তাই যোগাযোগের বা নেটওয়ার্কিং দক্ষতা তৈরিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রতি সপ্তাহে না পারলেও মাসে একবার হলেও পুরোনো বন্ধুদের খোঁজখবর নেয়া, ক্যারিয়ার নেটওয়ার্কিং রিলেটেড সভা-সমিতিগুলোতে অংশ নেয়া যায়, বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন বন্ধু তৈরি হয়, অনুভূতি বা আইডিয়া প্রকাশের সময় যোগাযোগ দক্ষতা কাজে লাগানো যায় এবং সর্বোপরি- লিংকডইন ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থাকা প্রয়োজন।

৬. নিজ পেশা সম্পর্কিত জার্নাল রাখা ও পড়া: প্রতিটি মানুষ তার পেশায় সাফল্যের রহস্য জানতে চায়। সমস্ত সফল মানুষদের তেমন কোনো গোপনীয়তা নেই। তবে তাদের থাকে একটি পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কোন কোন সরঞ্জামগুলো প্রয়োজন তা জানার সঙ্গে সঙ্গে সঠিকভাবে প্রায়োগিক ক্ষমতা। নিজ পেশা সম্পর্কিত জার্নালগুলোতে এ ধরনের অনেক অভিজ্ঞতা, সাম্প্রতিক বিষয়াবলি, প্রতিবন্ধকতা, উত্তরণের উপায়, সফলতার বাস্তব বিষয়গুলো জানা যায়। যা কর্মজীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে। সেখানে নিজের অভিজ্ঞতা, চিন্তাভাবনা, লেখা বা প্রাসঙ্গিক অনেক কিছু শেয়ার করা যায়। তাই দৈনিক বা সাপ্তাহিক বা অন্তত মাসিক একটা জার্নাল হলেও রাখা প্রয়োজন। স্বীয় লক্ষ্য ও অগ্রগতি নির্ধারণ এবং তা মূল্যায়ন করতে জার্নালগুলো সহায়ক হতে পারে।

৭. যোগ্য মেন্টর বা পরামর্শদাতা নির্বাচন: দ্য সাকসেস ফ্যাক্টর বইয়ে গবেষণার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে- অলিম্পিক বিজয়ী, নোবেলজয়ী, মহাকাশচারীসহ সর্বোচ্চ সাফল্য পাওয়া ব্যক্তিরা সব সময় মেন্টর বা পরামর্শদাতাদের দিয়ে নিজেদের ঘিরে রাখে। তারা জানে, একাই সাফল্য পাওয়া সম্ভব তাদের জন্য। কিন্তু এরপরও সাধারণের চেয়ে দূরে সরে গিয়ে একাধিক পরামর্শদাতার সঙ্গে নিজেদের সব সময় সম্পৃক্ত রাখে। যে কোনো ক্যারিয়ারে সাফল্য পেতে হলে যোগ্য পরামর্শদাতার দ্বারস্থ হতেই হবে। তারা প্রশংসা ও সমালোচনা, সমর্থন এবং চ্যালেঞ্জের একটা ভারসাম্য এনে দেবে। একজন পরামর্শদাতা সব সময়ই সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে এবং ক্যারিয়ারে কখনো কর্মক্ষমতা নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান করতে পারবে।

একজন পরামর্শদাতা তার জুনিয়রকে এমন সব চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত করবে, যেগুলোর কথা হয়তো আগে থেকে জানা যায়নি। যে ব্যক্তি বেশি সফল সে অবশ্যই অন্যান্য সফল ব্যক্তিদের চেনে, যারা অন্যদের প্রয়োজনে এগিয়ে আসবে। একজন মেন্টরের সাধারণত বলার মতো একটি নেটওয়ার্ক থাকে, যেটি ব্যবহার করে সে অন্যকে সাহায্য করতে পারবে। মেন্টররা জানেন এবং বুঝতে পারেন, কে বা কী একজন মানুষের ক্যারিয়ারকে লাইনচ্যুত করতে পারে। সেসবের কাছ থেকে রক্ষা করার উপায় বের করে দেয় মেন্টর। অনেক কাজই আছে যেগুলো প্রচারযোগ্য না, অনেক কাজই আছে যেগুলো ক্যারিয়ারে কোনো সুফল বয়ে আনবে না। সেগুলো থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করবে একজন পরামর্শদাতা। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে জটিল চরিত্রদের কীভাবে সামলাতে হয় সেটাও শিখিয়ে দেবেন মেন্টর।

লেখক: হেড অব এইচআর, স্টার সিরামিকস লিমিটেড

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ