ঢাকা, শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৯ জিলকদ ১৪৪৫

নির্বাচনের ভোটের মাঠ মাদক কারবারির দখলে

প্রকাশনার সময়: ০৪ মে ২০২৪, ১৬:২৬

কক্সবাজারে মাদকের প্রবেশদ্বার হচ্ছে বাসটার্মিনাল। উখিয়া-টেকনাফের সীমান্ত থেকে ইয়াবা আইসসহ নানা মাদকদ্রব্য এনে টার্মিনাল থেকে পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ফলে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে বাস টার্মিনাল লারপাড়া সংলগ্ন এলাকায় মাদক করবারির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে অনেকে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মাদক এনে টার্মিনাল থেকে বাস ড্রাইভার হেলপারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জোগান দিয়ে আসছে লারপাড়ার মাদকসম্রাটরা। তারাই এখন কক্সবাজার পৌরসভাসহ ঝিলংজার সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। তাদের একজন পরিবহন শ্রমিক থেকে মাদক কারবারে ফুলে ফেঁপে উঠা আত্মস্বীকৃত ইয়াবা সম্রাট শাহজাহান আনসারী। এক সময়ের রিক্তহস্ত শাহজাহান অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সম্প্রতি সস্ত্রীক কারাভোগের পর এলাকায় ফিরেছেন।

এই মাদকসম্রাটের টাকার ছড়াছড়ি ও দাপটের আঁচ পড়েছে চলমান কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাচনে। অভিযোগ উঠেছে, জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করছেন এই মাদক সম্রাট। এই ইয়াবা ডনের গড ফাদার উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন। ফলে ইয়াবা ডন শাহজাহান কালো টাকা ছিটিয়ে প্রভাব খাটাচ্ছেন ভোটারদের ওপর।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়ে ভোটের মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বহু দুর্নীতে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের এক নেতা। তাকে ঘিরে নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন নতুন পুরাতন মিলে অর্ধশত মাদক কারবারি। যারা ওই নেতাকে আশ্রয় থেকে মাদক কারবারি করে জেলার অন্যতম সম্পদশালী পরিবারে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগে রয়েছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, আওয়ামী লীগ নেতার সমর্থনে টাকার ব্যাগ নিয়ে তাকে জেতাতে মাঠে নেমেছে কক্সবাজারের মাদকসম্রাট শাহজাহান আনসারীসহ তার অনুসারীরা।

আলী আকবর, নাজির হোসাইন, মনজুর, ইমরান, শফিউলসহ এলাকাবাসী বলেন, ঝিলংজার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় গিয়ে রাতের আধাঁরে ভোটারদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে টাকা দিচ্ছেন শাহজাহানসহ তার অনুসারীরা। এসময় ওই নেতাকে ভোট দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে যে কোনো বিপদে ওই নেতার হয়ে তিনি তাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালে টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের হাতে আত্মসমর্পণ করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ও আত্মস্বীকৃত ১০২ ইয়াবা কারবারি। তাদের অন্যতম শাহজাহান আনসারী। এরপরই শাহজাহান ও তার পারিবারিক সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। শাহজাহান ও তার স্ত্রী জিগারুননেছার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে শাহজাহানকে উভয় মামলায় আসামি করা হলেও তার স্ত্রীকে একটিতে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

দুদকের করা ওই মামলায় দীর্ঘদিন সস্ত্রীক কারাভোগের পর সম্প্রতি জামিনে বেরিয়ে এসে ওই নেতার হয়ে ভোটের মাঠে কালো টাকা ছিটাচ্ছেন। তার সাথে কাজ করছে মাদক কারবারিদের আরেকটি দল। এমটাই দাবি করছেন ভোটারসহ সংশ্লিষ্টরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণ করেছিলেন ইয়াবা সম্রাট শাহজাহান আনসারী। কালের আবর্তে পরিস্থিতি বদলে গেলে ফের জামিনে বের হয়ে আসেন। বন্দুকযুদ্ধে নিহত দেশের শীর্ষ ইয়াবা মাফিয়া হাজি সাইফুলের ডানহাতখ্যাত শাহজাহান আনসারী পূর্বেকার সব ইয়াবা কারবারির সঙ্গে যোগাযোগ পুনরুদ্ধার করে নতুন করে নবোদ্যমে সারা দেশে সরবরাহ করে যাচ্ছে ইয়াবা। নিজেকে ব্যবসায়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে জোরপূর্বক হোটেল দখলে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

আরও জানা যায়, ফুটবলার ও পরিবহণ কর্মচারী হিসাবে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জীবিকা নির্বাহ করে এলেও ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে শাহজাহান আনসারী ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে মাদক পাচারকারী সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। এরপর থেকে তাকে পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। কয়েকজনের এই সিন্ডিকেটের প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসাবে কাজ করতেন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া দেশের শীর্ষ ইয়াবা মাফিয়া হাজি সাইফুল করিম। সহযোগী ছিলেন শাহজাহান আনসারীর ছোট ভাই আবু সুফিয়ান আনসারী। সিন্ডিকেটে ছিল সাবেক পুলিশ সদস্য, আইনজীবী, স্থানীয় গ্রাম ডাক্তার ও বিকাশ দোকানদারসহ আরও অনেকে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর শাহজাহানের বাড়িতে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। কিন্তু টের পেয়ে আগেই পালিয়ে যাওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। ক্রীড়ামোদীদের অভিযোগ, এক সময় ইয়াবা গডফাদার শাহজাহান আনসারীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল কক্সবাজারের ফুটবল অঙ্গণ। তখন তার কথাই যেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার আইন ছিল।

সরকারের পাঁচটি সংস্থার সমন্বয়ে তৈরি করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকায় জেলার ইয়াবা ডন হিসাবে যাদের নাম উল্লেখ রয়েছে তার মধ্যে শাহজাহান আনসারী অন্যতম। সামান্য পরিবহন কর্মচারী থেকে ইয়াবা কারবারি করে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া আনসারীর কব্জায় ছিল জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। তবে আত্মসমর্পণের পর তার প্রভাবে ভাটা পড়েছে।

এদিকে আওয়ামী লীগের ওই নেতার হয়ে প্রকাশ্যে ভোটের মাঠে নেমেছে কক্সবাজারের আলোচিত মাদক কারবারি রোজিনা। রোজিনার সঙ্গে ভোট প্রচারে নেমেছে একদল চিহ্নত মাদক কারবারিরা। তবে রোজিনা ও তার সহযোগীরা খুচরা মাদক কারবারি বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। এছাড়াও ওই নেতার সঙ্গে নির্বাচনি প্রচার প্রচারণায় বহু মাদক কারবারিসহ দাগী আসামিদের দেখা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ওই আওয়ামী লীগ নেতার পক্ষে বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারিরা দেদারসে টাকা খরচ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে, যাতে আগামীতে ঝুটঝামেলা হলে তার সাহায্য পাওয়া যায়।

এবিষয়ে কথা বলতে অভিযুক্ত শাহজাহান আনসারীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

যদিও আওয়ামী লীগের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীর দাবি, দলের নেতাকর্মীরাই তার জন্য ভোট করছে। কোনো চিহ্নিত মাদক কারবারি তার সঙ্গে নেই। বরং প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য প্রার্থীর সমর্থকরা মিথ্যাচর করছেন।

নয়াশতাব্দী/এনএইচ/এসএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ