ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

নিখোঁজের ২২ মাস পর জানা গেল খুন হয়েছেন মাফিজুল!

প্রকাশনার সময়: ০৩ মার্চ ২০২৪, ১৮:৫৭ | আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৪, ১৯:৪৫

এ যেন সিনেমাকেও হার মানানো ঘটনা। স্বজনরা মনে করেছিলেন নিখোঁজ মাফিজুল একদিন না একদিন ফিরে আসবেন। কিন্তু নিখোঁজের দুই বছর পর জানা গেল, তিনি খুন হয়েছেন, পরকীয়া সম্পর্কের জের ধরে। এমনই চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে নাটোরের গুরুদাসপুরে।

রোববার (৩ মার্চ) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে চাঁচকৈড় পুরানপাড়া মহল্লার একটি বালিকা মাদরাসার সেপটিক ট্যাঙ্কের পাশে হত্যাকাণ্ডের শিকার মাফিজুলের পুঁতে রাখা দেহাবশেষ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ ঘটনায় অভিযুক্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মরদেহটি উত্তোলনের আগে রোববার বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে নেওয়া হয় তিন আসামিকে। আসামিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ও ফায়ার সার্ভিসের চার ঘণ্টার প্রচেষ্টায় মেঝের টাইলস এবং ঢালাই কেটে প্রায় দশ ফুট মাটি খুঁড়ে মরদেহটি উদ্ধার করে পুলিশ।

এ সময় গুরুদাসপুরের সহকারি কমিশনার (ভূমি) মেহেদী হাসান শাকিল, নাটোরের অর্থ ও প্রশাসন বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাইনুল ইসলাম, ক্রাইম এন্ড অবস বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শরিফুল ইসলাম, ফায়ার সার্ভিসের রাজশাহী বিভাগের সহকারি পরিচালক খুরশেদ আলম, সিংড়া-গুরুদাসপুর সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার আক্তারুজ্জামান, চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান ও গুরুদাসপুর থানার অফিসার ইনচার্জ উজ্জল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান জানান, নিহতের পুরো দেহ পাওয়া গেছে। তবে মাংস পচে হাড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

এর আগে শুক্রবার (১ মার্চ) এজাহার নামীয় তিনজনসহ অজ্ঞাত আরও তিনজনকে অভিযুক্ত করে গুরুদাসপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের মা মাহিনুর বেগম। হত্যাকাণ্ডের শিকার মাফিজুল ইসলাম গুরুদাসপুর পৌর সদরের চাঁচকৈড় খলিফা পাড়া মহল্লার আজাদ প্রামাণিকের ছেলে। তিনি পেশায় রঙ মিস্ত্রি ছিলেন।

নিহতের মায়ের দায়ের করা মামলায় এজাহার নামীয় আসামিদের মধ্যে নৈশ্যপ্রহরী তাহের খলিফা (৬৫), আল-হাবিব (৩৯) ও আশরাফুলকে (৪৫) এবং অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে গৃহবধূ তানজিলাকে (৩৫) গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন। অধিকতর তদন্তের জন্য গ্রেপ্তার চার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শনিবার (২ মার্চ) বিকেল থেকে তিনদিনের পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র বলছে, আসামি তানজিলার পিতা তাহের খলিফা বাড়ির পাশের চাঁচকৈড় বালিকা মাদরাসার নৈশপ্রহরী হিসেবে কাজ করেন। গুরুদাসপুর পৌর শহরের চাঁচকৈড় পুড়ান পাড়া মহল্লায় তাদের বাড়ি। ২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল তানজিলার মাধ্যমে পরকীয়া প্রেমিক মাফিজুলকে রাত ১১টার দিকে বাড়িতে ডেকে নেন তাহের খলিফা। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন মেয়ে জামাই অর্থাৎ তানজিলার স্বামী আল-হাবিব ও তানজিলার আরেক পরকীয়া প্রেমিক আশরাফুল ইসলাম।

একপর্যায়ে চারজন মিলে মাফিজুলকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি গোপন করতে রাতেই বাড়ির পাশের দাখিল মাদরাসার নির্মাণাধীন টয়লেটের মেঝের বালু খুঁড়ে মরদেহ পুঁতে রাখা হয়। এদিকে সন্তানকে খোঁজখুঁজি করে সন্ধান না পাওয়ায় ২০২২ সালের ৭ মে গুরুদাসপুর থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরী করেন নিহত মাফিজুলের মা।

নাটোরের অর্থ ও প্রশাসন বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাইনুল ইসলাম বলেন, আল-হাবিব ছিলেন তানজিলার দ্বিতীয় স্বামী। স্বামীর অগোচরে নিহত মাফিজুলের সাথে তানজিলার পরকীয়ার সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিষয়টি জানাজানি হলে আল-হাবিব তানজিলা দম্পতির মধ্যে কলহ তৈরি হয়। একপর্যায়ে আসামিরা পরকীয়া প্রেমিক মাফিজুলকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন।

২২ মাস পর যেভাবে রহস্য উদঘাটন হলো-

সিংড়া-গুরুদাসপুর সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার আক্তারুজ্জামান বলেন, ২০২২ সালে হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হওয়ার পর ২০২৩ সালে তানজিলার সাথে স্বামী আল-হাবিবের আবারও কলহ সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে তানজিলার দায়ের করা যৌতুকের মামলায় জেলহাজতে যান আল-হাবিব। জেলহাজতে থাকা অবস্থায় আল-হাবিব গুরুদাসপুরের জাকির মুন্সি নামের ব্যক্তির কাছে মাফিজুলকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। জাকির মুন্সি জামিনে বেরিয়ে এসে বিষয়টি প্রকাশ করলে থানায় হত্যা মামলা রুজু হয়।

গ্রেপ্তারের পর আসামিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মরদেহ পুতে রাখার স্থানটি শনাক্ত করেন তারা। দুইদিন মাদরাসাটি পুলিশ পাহারায় রাখা হয়।

এদিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চার বছর বয়সী শিশুকে বুকে জড়িয়ে ডুকরে কাঁদছেন নিহত মাফিজুলের স্ত্রী। ছেলের শোকে কাঁদতে-কাঁদতে মূর্ছা যাচ্ছেন মা-বাবা। তাদের কান্নায় আশপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।

নিহতের চাচাতো ভাই স্থানীয় কাউন্সিলর শেখ ফরিদ বলেন, আসামি আশরাফুলের সাথে একাধিক নারীর সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি আশরাফুলের সাথে তানজিলার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। পরিকল্পিতভাবে মাফিজুলকে খুন করেছেন আসামিরা।

মামলার বাদী মাহিনুর বেগম বলেন, দুই ছেলের মধ্যে মাফিজুল বড়। ছেলে নিখোঁজের পর থেকে পথ চেয়ে বসে থাকতেন তিনি। বিশ্বাস ছিল ছেলে ফিরে আসবে। তবে লাশ হয়ে ফিরবে এটি তিনি মানতে পারছেন না। তিনি আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ