ঢাকা, রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫

মহাপরিকল্পনায় সড়ক নেটওয়ার্ক

প্রকাশনার সময়: ০৭ মে ২০২৪, ০৭:২৩

আন্তঃসংযুক্ত সড়ক করিডোরের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং স্থলবন্দরের মধ্যে যোগাযোগ উন্নয়নে একটি কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এ উদ্যোগটি ট্রেড লজিস্টিক ব্যবস্থাপনাকে সহজ করবে এবং এ অঞ্চলের তুলানমূলক উচ্চ পরিবহন খরচ কমিয়ে আনবে বলে বিভাগের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি প্ল্যানটির লক্ষ্য হচ্ছে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য সহজতর করা এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সংযোগ পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশীদের কাছে একটি উপ-আঞ্চলিক পরিবহন ও ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে গড়ে তোলা।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২৭ সালের মধ্যে এ মহাপরিকল্পনার মূল প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করতে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নকশাকৃত ও প্রস্তাবিত ১১০ কোটি ৭৫ লাখ টাকার কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক ৭৬ কোটি টাকা দেবে। কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং স্থলবন্দর, রেলওয়ে, নৌ টার্মিনাল, আন্তর্জাতিক সীমান্ত ও আন্তঃসীমান্ত অঞ্চলসহ মূল অবকাঠামোগুলোকে সংযুক্ত করে এমন সড়কগুলোর উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন করা হবে। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ফ্রেইট ট্রেনকে গুরুত্ব দিয়ে করিডোরভিত্তিক রেল উন্নয়নের প্রস্তাব দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ। এর লক্ষ্য সদ্য সমাপ্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ এবং অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোসহ বিদ্যমান রেল করিডোরগুলোর আন্তঃসংযোগ করা।

তারই ধারাবাহিকতায় নতুন এ প্রস্তাব হাতে নিয়েছে সড়ক ও জনপদ বিভাগ। ১৯ মার্চ বিভাগের প্রস্তাবিত কারিগরি সহায়তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনার জন্য একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার আয়োজন করে পরিকল্পনা কমিশন।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া বলেন, ‘এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। সড়ক ও জনপথ বিভাগের সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব এবং অন্যরা দ্রুতই একটি বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নেবেন কোন মডেলটি এটি বাস্তবায়নের জন্য সর্বোত্তম হবে’। এছাড়া বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কীভাবে এ প্রকল্পে আরও ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়েও আলোচনা চলছে।

এদিকে ভৌত অবকাঠামো বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বিঘ্নে রেল, সড়ক, নদী এবং বিমান পরিবহনকে একীভূত করে এমন একটি প্রকৃত মাল্টিমোডাল পরিবহন ব্যবস্থার খোঁজে তারা এডিবির সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছেন। সংস্থাটি এ ব্যবস্থার অধ্যয়ন এবং ডিজাইনের জন্য চারজন পরামর্শক নিয়োগ দিতে রাজি হয়েছে। এছাড়া সম্ভাব্যতা সমীক্ষার জন্য অর্থায়ন করতে প্রাথমিকভাবে সম্মত হয়েছে এডিবি। পরিকল্পনা কমিশনে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জমা দেওয়া প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর সড়ক করিডোর নির্মাণ করছে এবং উন্নয়ন কাজের জন্য ২৩টি স্থলবন্দর চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বন্দরগুলোকে উন্নত কালেক্টর সড়কের (আঞ্চলিক ও জেলা সড়ক) মাধ্যমে ধমনী সড়ক, রেল নেটওয়ার্ক এবং অভ্যন্তরীণ নদী বন্দরগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রাফিক এবং কার্গো ভলিউম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্য গেটওয়েগুলোর পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব রয়েছে।

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত চৌকি পেট্রাপোল-বেনাপোলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করতে গড়ে ১৩৮ ঘণ্টা সময় লাগে, যার মধ্যে ট্রান্স-লোডিং কার্গোতে ২৮ ঘণ্টা ব্যয় হয়। বিপরীতে, পূর্ব আফ্রিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে একই পরিমাণ ট্রাফিক পরিচালনাকারী সীমান্তগুলো অতিক্রম করতে ছয় ঘণ্টারও কম সময় লাগে বলে জানান কর্মকর্তারা।

সড়ক ও জনপদ বিভাগের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘পরিচালনার সক্ষমতার অভাবে বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ স্থলবন্দরেই একটি দীর্ঘ ও অনিশ্চিত বর্ডার ট্রানজিট সময় পরিলক্ষিত হয়’। যেমন ভারতের পেট্রাপোল ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্টের ৭৫০টি রপ্তানি ট্রাক পরিচালনা করার ক্ষমতা রয়েছে। তবে এটি কেবল ৩৭০টি ট্রাক ছাড়তে পারে। বাংলাদেশের বেনাপোল স্থলবন্দরের সর্বাধিক হ্যান্ডলিং ক্ষমতাও একই বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রস্তাবটি দেশের আর্টারিয়াল এবং কালেক্টর সড়কগুলোকে একটি সমন্বিত ট্রানজিট নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে চায় যা বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত এবং নেপাল নেটওয়ার্ক (বিবিআইএন), সাউথ এশিয়া সাবরিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক), এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের অধীনে চলমান এবং প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক করিডোরগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এ করিডোরগুলো কেবল অভ্যন্তরীণ পরিবহন পরিষেবা দেবে না, এগুলো প্রতিবেশী দেশগুলোতেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করবে বলে প্রস্তাবে বলা হয়েছে। মূলত অপর্যাপ্ত পরিবহন পরিকাঠামোর কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক বাণিজ্য অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের তুলনায় কম বলে প্রস্তাবে জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ২০১৫ সালে বিবিআইএন দেশগুলোর স্বাক্ষরিত মোটর ভেহিকল চুক্তিতে (এমভিএ) বলা হয়েছে, এসব দেশ আন্তঃদেশীয় পরিবহন এবং বাণিজ্যের সুবিধার্থে অভ্যন্তরীণ সড়ক পরিবহন অবকাঠামো উন্নত করবে।

বিশ্বব্যাংকের লজিস্টিক পারফরমেন্স ইনডেক্স ২০২৩-এ ৫ স্কোরে ২.৬-এ স্থান পেয়ে কম্বোডিয়ার সঙ্গে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। ভারত, চীন এবং ফিলিপাইনের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ অঞ্চলের অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পরিবহন খরচ বেশি। দেশে প্রতি কিলোমিটার প্রতি টন পরিবহন খরচ ট্রাকের ক্ষেত্রে ০.০৬ ডলার এবং ট্রেলারের জন্য ০.১২ ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে।

এ বৈষম্য দেশের রপ্তানি কর্মক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাধাগ্রস্ত করে। এছাড়া বাংলাদেশের শিল্প খাতের সামগ্রিক লজিস্টিক খরচের ১৭-৫৬ শতাংশ পর্যন্ত পণ্য পরিবহনে ব্যয় হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বৈশ্বিক ঋণদাতা গোষ্ঠীটি উল্লেখ করেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের ডুয়েল টাইম (একটি জাহাজের বন্দরে অবস্থান করা সময়) কমিয়ে, যানজট হ্রাস করে মহাসড়কের গতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটারে বাড়িয়ে এবং লজিস্টিক অবকাঠামো ও পরিষেবার উন্নয়ন করে বাংলাদেশের রপ্তানি বর্তমান ১৯ শতাংশ থেকে বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রস্তাবে স্বীকার করা হয়েছে যে, দেশে লজিস্টিক খরচ অন্যতম বেশি যা ব্যবসাকে প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো দরকার— বিশেষ করে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর যখন বাংলাদেশ কিছু বাণিজ্য সুবিধা হারাবে এবং কঠোর প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।

প্রস্তাবে বলা হয়, ‘অদক্ষতার ফলে সৃষ্ট উচ্চ লজিস্টিক খরচ এবং বেশি লিড টাইম দেশের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করছে। যানজট এবং বিলম্ব দেশের সড়ক থেকে সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দর পর্যন্ত জাতীয় লজিস্টিক ব্যবস্থার একটি বড় ও বিস্তৃত সমস্যা’।

সড়ক ও জনপদ বিভাগের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশে পরিবহন পরিকাঠামো এবং পরিষেবা পরিবহন চাহিদার দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছে’।

বৈশ্বিক বাণিজ্যে দেশীয় শিল্পগুলোকে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে, ১০০টি পরিকল্পিত অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এবং বেশ কয়েকটি মেগা সংযোগ প্রকল্পের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে কেন লজিস্টিক অবকাঠামোর উন্নয়ন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে প্রস্তাবটিতে।

উদ্যোগকে সাধুবাদ বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের: যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক লজিস্টিক কোম্পানি এক্সপিডিটরস-এর কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ এরশাদ আহমেদ করিডোরভিত্তিক মাল্টিমোডাল পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার সরকারের উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। এটি তাদের দীর্ঘদিনের দাবিও ছিল।

বাজারে পণ্যের সুষ্ঠু সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মহাসড়ক নেটওয়ার্কের সঙ্গে রেলওয়ে এবং নৌপথ উভয়কে একীভূত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, ‘আমরা যদি আমাদের অভ্যন্তরীণ মাল্টিমোডাল পরিবহন নেটওয়ার্ক তৈরি করি তবে এটি কেবল প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করবে না বরং থাইল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।’

বাংলাদেশে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা এরশাদ আহমেদ আরও বলেন, ‘মাল্টিমোডাল ট্রেড লজিস্টিকস যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হয়, তাহলে স্বল্প দূরত্বের দেশগুলোর সঙ্গে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের ওপর নির্ভরতা কমবে এবং বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বিকল্প বাণিজ্যপথ পাবে। এতে সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হওয়ার ও সমুদ্রের ফ্রেইট চার্জ বৃদ্ধির এ সময়ে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যাবে।’

ভিয়েতনাম শিল্প খাতে নগদ প্রণোদনা বা কর অবকাশের সুযোগ দেয় না। তবুও এশীয় এ দেশটি তার চমৎকার লজিস্টিক অবকাঠামোর কারণে বৈশ্বিক রপ্তানি বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে বলে উল্লেখ করেন এরশাদ।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ