ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

পাহাড় ঘুরে আসছে মাদক

প্রকাশনার সময়: ১০ মে ২০২৪, ০৮:০০

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে নিয়মিত রুট বদলে পার্বত্য এলাকার রুটগুলো ব্যবহার করছে মাদক কারবারিরা। কক্সবাজার-ঢাকা রুটে কড়া নজরদারির কারণে এখন অনেক চালান দেশের পার্বত্য অঞ্চল ঘুরে আসছে। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ইয়াবা প্রথমে যাচ্ছে বান্দরবান, রাঙামাটি বা খাগড়াছড়ি; পরে সেখান থেকে আনা হচ্ছে ঢাকায়। এখান থেকে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে বেশকিছু মাদকের চালান জব্দের পর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এসব ক্ষেত্রে বাহক ধরা পড়লেও অধরায় থেকে যাচ্ছেন গডফাদাররা। এমন পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতনরা। পার্বত্য এলাকার রুটগুলোতে কঠোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার আদর্শ বৌদ্ধবিহারের প্রধান পুরোহিত ডিপু চাকমা এবং তার দুই সহযোগী আপেল বড়ুয়া ও মোমিন হাওলাদার ১৬ হাজার পিস ইয়াবাসহ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার ডিপু চাকমার ধর্মগুরু আরেক বৌদ্ব ভিক্ষুর শিষ্য আপেল বড়ুয়ার মাধ্যমে কাঁচা টাকার লোভে প্রবেশ করেন ইয়াবার জগতে। নিয়মিতই কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা থেকে ঢাকায় আসতেন হাজার হাজার পিস ইয়াবা বহন করে। নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় রুম ভাড়া নিয়ে অবস্থান করতে থাকা মোমিন হাওলাদারের কাছে নিরাপদে পৌঁছে দিতেন হাজার হাজার পিস ইয়াবা। এখান থেকে সেই ইয়াবা যেত ঢাকাসহ গাজীপুর, উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা এবং থানা পর্যায়ে। এ অবৈধ কাজ করে পেয়েছেন সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা করে। মূলত তারা বাহক হিসাবে কাজ করছেন। ঢাকা চট্টগ্রাম রুটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকার কারণে পেশাদার ইয়াবা ব্যবসায়ীরা রুট বদল করে গ্রেপ্তারকৃতদের সহায়তায় পাহাড়ি রুট ব্যবহার করে ঢাকায় ইয়াবা নিয়ে আসতেন।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিশনাল ডিআইজি পদে পদন্নতিপ্রাপ্ত) মশিউর রহমান বলেন, গ্রেপ্তার ডিপু চাকমার পিতা রূপায়ণ চাকমা ছিলেন খাগড়াছড়ি সদরের এক কাঠুরিয়া। সংসারের ঘানি টানার ক্লান্তি আর লিভারের রোগে আক্রান্ত হয়ে ৪৫ বছর বয়সেই মৃত্যুবরণ করার আগে স্বপ্ন দেখতেন ছেলে ডিপু চাকমা একজন প্রথিতযশা বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে লোভ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেবেন। আলোকিত মানুষ হিসেবে সমাজের হিংসা আর বিদ্বেষের অন্ধকারে ধৈর্য ও সহনশীলতার আলো ছড়াবেন। ছেলে ডিপো চাকমা সেই পথে অগ্রসর হয়েছিলেন বহুদূর। আলো ও শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে সাফল্যের মাঝপথে ছিলেন প্রায়। কারন ডিপু চাকমা ২০১২ সালে খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং ২০১৪ সালে দিঘীনালা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। ২০১৫ সালে সে রাঙ্গামাটি রাজবিহার পালি কলেজে ৫ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়ে তা সম্পন্ন করেন পালি শাস্ত্রে। সঙ্গে দীক্ষা নেন পুরোহিত হওয়ার, পরেন কঠিন চীবর ও গেরুয়া বসন। বিভিন্ন বৌদ্ধবিহারে পুরোহিত দায়িত্ব পালন শেষে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানাধীন বৌদ্ধবিহারের প্রধান হিসেবে এক বছর সম্মানের সাঙ্গ দায়িত্ব পালন করেন। পরে দায়িত্ব্ব গ্রহণ করেন খাগড়াছড়ি জেলা সদরে। সেখান থেকে বদলি হয়ে সর্বশেষ খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি থানাধীন আদর্শ বৌদ্ববিহারের প্রধান হিসেবে গত দুবছর ধরে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ২০১৬ সালে ভারতের মিজোরামের বৌদ্ধ ভক্তবৃন্দের আমন্ত্রণে রাঙ্গামাটির বরকল-হরিনা সীমান্ত হয়ে পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই বিএসএফের অনুমতি নিয়ে ভারতে যান এবং সেখানে ১০-১২ দিন অবস্থান করে একই পথে একইভাবে দেশে ফিরে আসেন। ২০১৯ সালে খাগড়াছড়ির পানছড়ির সীমান্ত দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যান। সেখানে ৭-৮ দিন অবস্থান করে একই পথে একই কায়দায় দেশে ফিরে আসেন।

ছোটবেলা থেকেই ধূমপানে আসক্ত চিরকুমার এ পুরোহিত খাগড়াছড়ি জেলা সদরে থাকাকালীন মোবাইল ব্রাউজিং করতে করতে পরিচিত হন অনলাইন জুয়ার সঙ্গে। সেখান থেকেই জুয়ায় আসক্তি। এসব জুয়ায় আসক্ত হয়ে এ বৌদ্ধ ভিক্ষু ইতোমধ্যে হারিয়েছেন প্রায় ১৫-২০ লাখ টাকা। অনলাইন জুয়ায় সর্বস্বান্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন ইয়াবা পরিবহনের কাজে নিজেকে সঁপে দেয়ার। এরপর বাহক হিসাবে নিয়মিতই কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা থেকে ঢাকায় আসতেন হাজার হাজার পিস ইয়াবা বহন করে।

মশিউর রহমান বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে সেনা-পুলিশের টহল; সীমান্ত জেলাগুলোর ঘাটে ঘাটে বিজিবি, র‍্যাব, পুলিশের চেকপোস্ট— কোনো কিছুই আটকাতে পারেনি এ গেরুয়া পুরোহিতকে। তার সঙ্গে মিয়ানমারসহ বাংলাদেশের কোন কোন ইয়াবা ব্যবসায়ীর সম্পর্ক আছে তার বিস্তারিত জানার জন্য পুলিশ রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেখানে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে পাহাড়ি রুট বেছে নেয় মাদক কারবারিরা। আর মোটা অঙ্কের টাকার লোভ দেখিয়ে এ কাজে বাহক হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষৃদ্র-নৃগোষ্ঠীর লোকজনকে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতনদের জানানো হয়েছে।

জনা গেছে, কক্সবাজার-ঢাকা রুটে কড়া নজরদারির কারণে এখন অনেক চালান দেশের পার্বত্য অঞ্চল ঘুরে আসছে। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ইয়াবা প্রথমে যাচ্ছে বান্দরবান, রাঙামাটি বা খাগড়াছড়ি; পরে সেখান থেকে আনা হচ্ছে ঢাকায়। এখান থেকে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সর্বশেষ ঢাকায় এক নারী ও তার জামাতাকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তাদের দেয়া তথ্যমতে, টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে গ্রেপ্তারকৃতরা ইয়াবা সংগ্রহ করেন। এরপর পার্বত্যাঞ্চল হয়ে ঢাকায় আসেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তারা বলেন, ঢাকায় গত দুই মাসে বেশ কয়েকটি ইয়াবার চালান জব্দ করা হয়, যেগুলো নিয়মিত রুটে আনা হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পার্বত্যাঞ্চল, কোনো কোনো সময় অন্য জেলা ঘুরেও চালান আনা হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ফাঁকি দিতে এসব কৌশল কাজে লাগাচ্ছে কারবারিরা। তবে তাদের কৌশল ব্যর্থ হচ্ছে। গোয়েন্দা তথ্য ও নজরদারির মাধ্যমে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

ডিএনসি ঢাকা মহানগর উত্তর কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার মেহেদী হাসান বলেন, মাদক কারবারের হোতারা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে কিছু মানুষকে দিয়ে ইয়াবা বহন করায়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরাও এতে জড়িয়ে পড়ছেন।

জিজ্ঞাসাবাদে কারবারিদের তথ্য অনুযায়ী, এক হাজার পিস ইয়াবা ঢাকায় পৌঁছানোর জন্য ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত পান তারা। একেকটি চালানে সাধারণত ১০ হাজার পিস ইয়াবা থাকে। সেই হিসাবে প্রতি চালানে মেলে কমপক্ষে এক লাখ টাকা। অর্থের মোহে অনেকেই এতে জড়িয়ে পড়ছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তারা অপ্রচলিত পথে ইয়াবা আনছেন।

ডিএনসি সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত বছরের আগস্ট মাসে গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে মংয়েছা চাকমা ও তার শাশুড়ি চাইন ছিং চাকমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছে পাওয়া যায় ৭ হাজার ২০০ পিস ইয়াবা। ঢাকায় এক মাদক কারবারির কাছে এ চালান হস্তান্তরের কথা ছিল। মংয়েছার বাড়ি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এবং চাইনের বাড়ি কক্সবাজারের উখিয়ায়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় তাদের কেউ সন্দেহ করবে না, এমন চিন্তা থেকে তাদের মাদক বহনের কাজে লাগানো হয়। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক বড় ইয়াবা কারবারির কাছ থেকে চালান বুঝে নিয়ে প্রথমে চলে যান বান্দরবান। সেখান থেকে ঢাকায় আসেন। এক থেকে দেড় বছর তারা ইয়াবা বহনের কাজ করেন। প্রতি মাসে সাধারণত একটি চালান পৌঁছে দিতেন তারা।

ডিএনসি ধানমন্ডি সার্কেলের পরিদর্শক তপন কান্তি শর্মা বলেন, মংয়েছাকে মাসখানেক আগেও ধরা হয়েছিল। তখন তার কাছে ইয়াবা পাওয়া যায়নি। তার এক সঙ্গী ইয়াবার চালান নিয়ে পালিয়ে যান। তখন থেকেই তার ওপর নজর রাখা হচ্ছিল। এক পর্যায়ে ইয়াবাসহ তাদের আটক করা সম্ভব হয়। তাদের মধ্যে মংয়েছার কাছে তিন হাজার ও তার শাশুড়ির কাছে বাকি ইয়াবা পাওয়া যায়। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এর আগে ১২ জুলাই ঢাকার গাবতলী থেকে ১১ হাজার ইয়াবাসহ সাধন তনচংগ্যাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বাড়ি রাঙামাটি। এদিকে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে ঢাকায় আসা ইয়াবার বড় চালান উদ্ধারের পর বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টনক নড়েছে। এ রুট দিয়ে কীভাবে ইয়াবা আনা হচ্ছে এবং জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাদকের সাতটি আন্তর্জাতিক রুট ধরে মিয়ানমারের শান স্টেট ও তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে ইয়াবা ও আইস বাংলাদেশে ঢুকছে। রুটগুলো হলো-মিয়ানমারের সান স্টেট-তুয়াঙ্গি-ইয়াঙ্গুন হয়ে নৌপথে মহেশখালী। একইভাবে মিয়ানমারের সিত্তে হয়ে বরিশালের উপকূলে আসে ইয়াবার চালান। মিয়ানমারের মান্দালে-তুয়াঙ্গি-মাগওয়ে-মিনুর-পাদান-সিত্তেই-মংডু হয়ে টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি। ইয়াবার কিছু কিছু চালান আবার মিয়ানমার থেকে ভারত হয়েও বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর মধ্যে রয়েছে-মান্দালে-সাগাইং অঞ্চল-মনোয়া-কালে-মোরে (মণিপুর) আইজল (মিজোরাম)-পানিসাগর-শিলং-করিমগঞ্জ হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত। শিলং-শিলিগুড়ি-মালদা হয়ে যশোর এবং সাতক্ষীরার তিনটি রুট। তবে এখন পাহাড়ি রুটগুলো মাদক পাচারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছেন। এ কারণে ওই রুটের যানবাহনে চলাচলকারী যাত্রিদের ওপর কঠোর নজরদারি চালানো হচ্ছে। বাদ পড়ছে না ট্যুরিস্টরাও।

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ