ঢাকা, শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৯ জিলকদ ১৪৪৫

ধর্মগুরু থেকে ইয়াবাপাচারকারী

প্রকাশনার সময়: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:৩৩

মাথা ন্যাড়া, চোখে মোটা চশমা, পরনে কঠিন চিবর, গেরুয়া বসন, পায়ে চটি! এ যেন এক সাক্ষাৎ ধর্মদূত! তাকে কি সন্দেহ করা যায়? পৌরহিত্য আর পোশাকের বদৌলতে তিনি বারবার থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে এবার ধরা পড়েছেন গোয়েন্দা জালে।

ডিপু চাকমা নামে ওই বৌদ্ধ ভিক্ষু দুই সহযোগীসহ ১৬ হাজার ইয়াবা নিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন রাজধানীর রমনা এলাকার পেয়ারাবাগ থেকে। ডিপু চাকমা খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার আদর্শ বৌদ্ধ বিহারের প্রধান পুরোহিত। একজন ধর্মগুরু কীভাবে হয়ে গেলেন ইয়াবা পরিবহনকারী? এ প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। আশ্চর্য হয়েছেন গোয়েন্দরাও। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার অপর দুইজন হচ্ছেন- আপেল বড়ুয়া ও মোমিন হাওলাদার।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিশনাল ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মশিউর রহমান বলেন, ডিপু চাকমার পিতা রূপায়ন চাকমা ছিলেন খাগড়াছড়ি সদরের এক কাঠুরিয়া। সংসারের ঘানি টানার ক্লান্তি আর লিভারের রোগে আক্রান্ত হয়ে ৪৫ বছর বয়সেই মৃত্যুবরণ করার আগে স্বপ্ন দেখতেন ছেলে ডিপু চাকমা একজন প্রথিতযশা বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে লোভ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেবেন।

আলোকিত মানুষ হিসেবে সমাজের হিংসা আর বিদ্বেষের অন্ধকারে ধৈর্য ও সহনশীলতার আলো ছড়াবেন। ছেলে ডিপু চাকমা সেই পথে অগ্রসর হয়েছিলেন বহুদূর। আলো ও শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে সাফল্যের মাঝপথে ছিলেন প্রায়। কারণ ডিপু চাকমা ২০১২ সালে খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং ২০১৪ সালে দিঘীনালা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে।

২০১৫ সালে সে রাঙামাটি রাজবিহার পালি কলেজে পাঁচ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়ে তা সম্পন্ন করেন পালি শাস্ত্রে। সঙ্গে দীক্ষা নেন পুরোহিত হওয়ার, পরেন কঠিন চিবর ও গেরুয়া বসন। বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে পুরোহিত দায়িত্ব পালন শেষে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানাধীন বৌদ্ধ বিহারের প্রধান হিসেবে এক বছর সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।

পরে দায়িত্ব্ব গ্রহণ করেন খাগড়াছড়ি জেলা সদরে। সেখান থেকে বদলি হয়ে সর্বশেষ খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি থানাধীন আদর্শ বৌদ্ধ বিহারের প্রধান হিসেবে গত দুই বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ২০১৬ সালে ভারতের মিজোরামের বৌদ্ধ ভক্তবৃন্দের আমন্ত্রণে রাঙামাটির বরকল-হরিণা সীমান্ত হয়ে পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই বিএসএফ এর অনুমতি নিয়ে ভারতে যান এবং সেখানে ১০/১২ দিন অবস্থান করে একই পথে একইভাবে দেশে ফিরে আসেন। ২০১৯ সালে খাগড়াছড়ির পানছড়ির সীমান্ত দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যান। সেখানে সাত/আট দিন অবস্থান করে একই পথে একই কায়দায় দেশে ফিরে আসেন।

ছোটবেলা থেকেই ধূমপানে আসক্ত চিরকুমার এ পুরোহিত খাগড়াছড়ি জেলা সদরে থাকাকালীন মোবাইল ব্রাউজিং করতে করতে পরিচিত হন অনলাইন জুয়ার সঙ্গে। সেখান থেকেই জুয়ায় আসক্তি। সে যে সকল অনলাইন জুয়ার সাইটে নিয়মিত জুয়া খেলত তার কয়েকটি হলো 1xBET, V24BET, Fxbet, CX Crickex. Online।

এসব জুয়ায় আসক্ত হয়ে এ বৌদ্ধ ভিক্ষু ইতোমধ্যে হারিয়েছেন প্রায় ১৫/২০ লাখ টাকা। এ টাকার মধ্যে ছিল নিজের বেতন, দান দক্ষিণা, মৃত বাবার ভিটেমাটি বিক্রয়লব্ধ টাকা এবং মায়ের কর্জ করে নেয়া দেড় লাখ টাকা। অনলাইন জুয়ায় সর্বস্বান্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন ইয়াবা পরিবহনের কাজে নিজেকে সঁপে দেয়ার। মিস্টার ডিপু চাকমার ধর্মগুরু আরেক বৌদ্ধ ভিক্ষুর শিষ্য- মিস্টার আপেল বড়ুয়ার মাধ্যমে কাঁচা টাকার লোভে প্রবেশ করেন ইয়াবার জগতে।

নিয়মিতই কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা থেকে ঢাকায় আসতেন হাজার হাজার পিস ইয়াবা বহন করে। নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় রুম ভাড়া নিয়ে অবস্থান করতে থাকা মোমিন হাওলাদারের কাছে নিরাপদে পৌঁছে দিতেন হাজার হাজার পিস ইয়াবা। এখান থেকে সেই ইয়াবা যেত ঢাকাসহ গাজীপুর, উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা এবং থানা পর্যায়ে। এ অবৈধ কাজ করে পেয়েছেন সর্বনিম্ন ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা করে।

সঙ্গে যাতায়াত ভাড়া এবং খাবারের খরচ তো ছিলই। উচ্চশিক্ষা আর ধর্মের আলোয় আলোকিত মানুষ! মাথা ন্যাড়া, চোখে মোটা চশমা, পরনে গেরুয়া ত্রি-চিবর (চার খণ্ডের পরিধেয় বস্ত্র, যাতে রয়েছে দোয়াজিক, অন্তর্বাস, চিবর ও কটিবন্ধ) পায়ে চটি আর হাতে ব্রক্ষের মালা- এ যেন এক সাক্ষাৎ ধর্মদূত! একে কি আর সন্দেহ করা যায়?

মশিউর রহমান বলেন, পৌরহিত্য আর পোশাকের বদৌলতে বারবার থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। পার্বত্য অঞ্চলে সেনা-পুলিশের টহল; সীমান্ত জেলাগুলোর ঘাটে ঘাটে বিজিবি, র‍্যাব, পুলিশের চেকপোস্ট- কোনো কিছুই আটকাতে পারেনি এ গেরুয়া পুরোহিতকে।

প্রথম ধরা খেলেন বেরসিক ডিবি লালবাগ বিভাগের পুলিশের কাছে। অনলাইন জুয়ার আসক্তির কারণে একজন সম্মানিত মানুষ কীভাবে পতিত হতে পারেন অসম্মানের পঙ্কিলতায়, একজন আলোকিত মানুষ নিজেই কীভাবে ডুবে যেতে পারেন অন্ধকারে, একজন সচ্ছল মানুষ কীভাবে হতে পারেন নিঃস্ব, একজন দায়িত্বশীল ধর্মগুরু কীভাবে হতে পারেন ইয়াবা নামক মাদকের পাচারকারী- ডিপু চাকমা তার-ই এক করুণ দৃষ্টান্ত। তার সঙ্গে মিয়ানমারসহ বাংলাদেশের কোন কোন ইয়াবা ব্যবসায়ীর সম্পর্ক আছে তা বিস্তারিত জানার জন্য পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করেছেন।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ