জীবনে তিনি কোনোদিন মদ স্পর্শ করেননি, জীবনে তিনি ব্যবসায় অসৎ পথ অবলম্বন করেননি। তিনি ছিলেন নরম মনের একজন হালকা পাতলা গঠনের মানুষ। তিনি কোনোদিন গীবত করেননি। তাকে কোরাইশরা খুব ভালোবাসতো ইসলাম গ্রহণ করার আগে। তার একটি পারদর্শিতা ছিল, তিনি কোন গোত্রের ওপর থেকে নিচ সবকিছুই জানতেন, যা ইংরেজিতে আমরা বলি ‘enealogy’।
তিনি সত্যকে খুঁজছিলেন কারণ তিনি জানতেন যে এইসব মূর্তিকে পূজা করার কোনো মানেই হয় না। আর তিনিও জীবনে মূর্তিপুজা করেননি।
তিনি একদিন কাবার পাশে বসে ছিলেন, এসময় এক কবি উমাইয়্যা ইবনে আবিস সালত পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, এখনই সময় হয়েছে একজন নবীর আগমনের— হয় তোমার গোত্র থেকে না হয় আমার গোত্র থেকে আসবেন। তিনি দৌঁড়ে ওরাকা বিন নাউফালের কাছে গিয়ে সব বললেন। ওরাকা বললেন, হ্যাঁ এখনই সময় এসে গেছে একজন নবীর আগমনের।
মুহাম্মদ (সা.) যখন নবুয়তের দাবি করলেন, কোনো দ্বিধা ছাড়াই তিনি দৌড়ে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তিনি আগে থেকেই সত্যের খোঁজ করছিলেন। তিনি আর কেউ নন, উম্মতের প্রিয়তম সাহাবি আবু বকর আস-সিদ্দিক (রা.)।
ইসলাম গ্রহণ করার পর তিনি ইসলামের দাওয়াত নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। অনেককে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন। তার দাওয়াতে সাড়াও দেন তাদের অনেকেই। তাদের মধ্যে ছিলেন যুবাইর ইবনুল আওয়াম, উছমান ইবনে আফফান, তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ, উসমান ইবনে মাঘলুম, আবু উবাইদা আমির ইবনুল জাররাহ, আবু সালামা ইবনে আব্দিল আসাল, আরকাম ইবনে আবিল আরকাম (রা.)। তিনি তার পরিবারকেও দাওয়াত দেন।
তিনি ইসলামের প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামের দাওয়াত জনগণের সামনে দিয়েছিলেন। আর এরপর কুরাইশরা তাকে খুব বাজেভাবে আক্রমণ করে মারতে থাকে, যতক্ষণ না তার গোত্রের মানুষেরা এসে তাকে বাঁচায়। তার হুঁশ ফিরলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘মুহাম্মদ (সা.)-এর কী হলো? তিনি কেমন আছেন?’ ওয়াল্লাহি নবীর জন্য এরকম ভালোবাসা এই উম্মতের আজ আর নেই। থাকলে আজ আমরা এরকম থাকতাম না।
তারপর তিনি বললেন, ‘আমি দুচোখে না দেখে আমি এক ফোঁটা পানিও পান করবো না। তারপর তিনি নবীকে দেখার পরই খাদ্য গ্রহণ করেন। সুবাহানআল্লাহ! নবীর প্রতি এত ভালোবাসা, কোথায় আমাদের ভালোবাসা?
তিনি মানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না। সর্বদা সবাইকে তিনি সাহায্য করতেন। তিনি খুব বেশি কান্না করতেন। তিনি সবচেয়ে বেশি দাস মুক্ত করেছেন, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিলাল ইবনে রাবাহ (রা.)
যখন আল্লাহর পক্ষ প্রথম হিজরতের অনুমতি আসলো, তিনি হিজরত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পথে ইবনুদ দাগিনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সে তাকে নিরাপত্তা দিয়ে মক্কায় রাখে। আগেরকার সময় তো আর ভিসা ছিলো না, প্রটেকশন দেয়া-নেয়ার মাধ্যম ছিলো।
মিরাজের ঘটনার পর মক্কায় এক হৈ-হুল্লড় পড়ে গেল। রাসুলুল্লাহ যখন তাদের মিরাজের ঘটনা খুলে বললেন, মক্কার কাফিররা বিশ্বাস করলো না। উল্টা হাসি-তামাশা শুরু করলো। এদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি আবু বকর (রা.)কে বললো ‘মুহাম্মদ এই এই ঘটনা বলেছেন’ তুমি কি তা বিশ্বাস কর? তিনি উত্তরে বললেন, ‘তিনি যদি বলে থাকেন, তাহলে তা সত্য এবং আমি তা বিশ্বাস করি।’ এরপরই তিনি ‘আস-সিদ্দিক’ উপাধি পান।
আবু বকর (রা)-এর ঈমান ও রাসুল (সা.)-এর প্রতিটি কথার ওপর অগাধ বিশ্বাসের এটি কেবল একটি উদাহরণ। এরকম হাজারো দৃষ্টান্ত ও নজির দিয়ে তার পুরো জীবনই ছিল ভরপুর। আর আমাদের?
তার কাছে যত টাকা ছিল তিনি তার সবই ইসলামের জন্য ব্যয় করেছেন। গরিব মুসলিমদের দিয়ে দিতেন। দাস মুক্ত করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি প্রতিটি মানুষের উপকারের ঋণ পরিশোধ করেছি। কিন্তু আবু বকরের উপকার এমন যে, তা পরিশোধ করতে আমি অক্ষম। তার প্রতিদান আল্লাহ দেবেন। তার অর্থ আমার উপকারে যেমন এসেছে, অন্য কারো অর্থ তেমন আসেনি।’
দেখুন আল্লাহ একজন ব্যক্তি দিয়ে ইসলামের কত কিছু করিয়েছেন। অথচ ইসলামের জন্য সামান্য কিছু করেই ভাবতে থাকি— আমরা আছি বলেই ইসলাম আছে। না, কখনই না। আপনার আসার আগেই আল্লাহ এই ধর্মকে অন্যদের দিয়ে সাহায্য করিয়েছেন। আল্লাহর সৈনিক অনেক।
যখন হজের সময় আসতো, রাসুলুল্লাহ এবং আবু বকর হজ কাফেলাগুলোয় গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। ইসলাম কী বুঝাতেন। অনেকেই এখান থেকে ইসলাম গ্রহণ করে।
রাসুলুল্লাহ হিজরতের জন্য বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। মক্কায় অবস্থান প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল, তখন তিনি রাসুলুল্লাহকে বলতেন— এই গোত্রের এই এই বৈশিষ্ট্য। তারপর নবীজি (সা.) সেসব মাথায় রেখে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন।
এরপর যখন মদিনার হিজরতের অনুমতি আসলো, রাসুলুল্লাহ আবু বকরকেই সাথী হিসেবে নিলেন। তারা অনেক কষ্ট করে পাহাড়ের ওপর লুকিয়ে থেকে, সমুদ্রের পাশে পথ ধরে মদিনার উদ্দেশ্যে হিজরত করেন। পথে তিনি রাসুলুল্লাহর নিরাপত্তা নিয়ে অনেক উদ্বিগ্ন ছিলেন।
তিনি রাসুলুল্লাহর সঙ্গে সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, একটিও বাদ যায় নি। তিনি রাসুলুল্লাহর সঙ্গে একদম ছায়ার মতন থাকতেন, রাসুলুল্লাহর প্রিয় সাথী ছিলেন তিনি।
আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর পেশা ছিল ব্যবসা। ব্যবসা করে যা পেতেন বেশির ভাগ ইসলামের জন্য ব্যয় করতেন। দুঃখীদের সাহায্য করতেন। তাবুকের যুদ্ধের সময় তিনি নিজের সব সম্পত্তি আল্লাহর রাস্তায় দিয়ে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন জিজ্ঞেস করলেন, ঘরে কী রেখে এসেছো? তিনি উত্তর দিলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে রেখে এসেছি।’ সুবহানাল্লাহ! আর আমরা ফকিরকে ৫ টাকা দিতেও ১০০ বার চিন্তায় পড়ে যাই— দিবো কি দিবো না।
মক্কা বিজয়ের দিন যখন তার পিতা আবু কুহাফা রাসুলুল্লাহর হাতে হাত রেখে শাহাদাহ পাঠ করেন, তিনি অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার বাবার হাত আপনার হাতের ওপরে রাখা দেখার চেয়ে আপনার চাচার হাত দেখলে আমি এর চেয়ে বেশি খুশি হতাম।’
রাসুলুল্লাহ যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে নেন তখন কেউ তা মানতে পারছিল না। তখন তিনিই এসে সবাইকে হুশে ফিরালেন। হ্যাঁ, রাসুলুল্লাহ আর এই দুনিয়াতে নেই। তিনি মারা গেছেন। তারপর সবাই আস্তে আস্তে বুঝতে পারলেন— সবার প্রিয় মানুষটি, প্রিয় নবী এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছেন একেবারে।
রাসুলুল্লাহর মৃত্যুর পর খেলাফতের দায়িত্ব পড়ে আবু বকর (রা.)-এর ওপর। তার আমলে ভুয়া নবী দাবিদারদের সঙ্গে মুসলিমদের যুদ্ধ হয়। যারা জাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল তাদের সঙ্গেও তিনি জেহাদ করেন। তিনি রাসুলুল্লাহর প্রেরিত শেষ মিলিটারি বাহিনী যারা মদিনায় অবস্থান করছিল তাদেরকে মহাপ্রতিকূল অবস্থার মধ্যে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেন।
মুসাইলামা কাজ্জাবের সঙ্গে যুদ্ধে অনেক হাফেজ সাহাবি শহিদ হয়। এ নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান ওমর (রা.)। এরপর আবু বকর (রা.) সিদ্ধান্ত নিয়ে কোরআন একত্র করার কাজ শুরু করেন। তার আমলে সাহাবিদের পর্যাপ্ত পরিমাণ ভাতা দেয়া হতো।
আমরা যা এক মুসলিম বিশ্ব পেয়েছিলাম তার ভিত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়া হয়েছিলো আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে।
একজন রাজনৈতিক কর্মীকে যদি তার দলের নেতাদের নিয়ে কিছু বলার জন্য বলেন, দেখবেন ঠাস ঠাস করে সব বলে দিচ্ছে। আর যখন কেউ আমাদের আশারা-মুহাশশারার নাম বলতে বলেন, আমরা হা করে তাকিয়ে থাকি, এটা আমার কী এসব ভাবি। আফসোস, সাহাবিদের সোনালী জীবন সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান বা আগ্রহই যেন নেই। অথচ তাঁদের ত্যাগের বদৌলতে আজ আমরা মুসলিম।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ