শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

অথচ আমরা অপরকে খারাপ বলি...

প্রকাশনার সময়: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৩:১৯ | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৩:২৪

মুনাফেক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মৃত্যুর সময় তার মুসলমান ছেলে সাহাবি দৌড়ে এলেন নবীজী (সা.)-এর কাছে! লাজলজ্জার কথা না ভেবে, অশ্রু চোখে রাসুলের কাছে আবেদন জানালেন, ‘হে আল্লাহর নবী! আপনার পবিত্র মুখে খানিকটা পানি নিয়ে সেটি গ্লাসে দেবেন? হয়তো আপনার মুখের ছোঁয়া পানির বরকতে আমার আব্বা মুসলমান হয়ে যাবে!’

আল্লাহর রাসুল দেরি করলেন না, তখনই নিজের মুখের বরকতময় পানি সাহাবির হাতে দিয়ে দিলেন।

তিনি বাড়ি ফিরে মুমূর্ষু বাবার সামনে পানির পাত্র তুলে ধরে বললেন, ‘নিন, পান করুন।’

ইবনে উবাই বলল, ‘এটা কী?’

ছেলে বললেন, ‘রাসুলের মুখের বরকতময় পানি, হয়তো এর বদৌলতে আপনার মৃত্যুযন্ত্রণা লাঘব হবে এবং আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দেবেন!’

ইবনে উবাই পানির পাত্র ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ‘কারও পেশাব নিয়ে আসো, সেটা পান করব; তবু মুহাম্মদের মুখের পানি পান করব না।’ (নাউজুবিল্লাহ)

ছেলে প্রচণ্ড রাগে দৌড়ে নবীজীর দরবারে গিয়ে বললেন, ‘আমার আব্বা সুস্পষ্ট মুনাফেক, অনুমতি দিন আমি আমার পিতার গর্দান কেটে নিয়ে আসি!’

আল্লাহর নবী তাকে মানা করে বললেন, ‘না, উনি তোমার পিতা... তার সঙ্গে অতিসুন্দর ব্যবহার করো, খেদমত করো, আমি কারও সম্পর্ক ভাঙতে আসিনি বরং মানুষের মাঝে সম্পর্ক গড়তে এসেছি, ফিরে যাও।’

সাহাবি বাড়ি ফিরে গেলেন, অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মৃত্যু হয়।

ছেলে এক বুক দুঃখ নিয়ে আবার দৌড়ে এলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। বুকে দুঃখ, চোখে মুখে অনুশোচনার লজ্জা, বাবার পাপের ভার যেন তার বুকে ভারি পাথর হয়ে বসে আছে। তবু সাহস করে আবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আব্বা মারা গেছেন। আপনার গায়ের একটা জামা দেবেন, আব্বার কাফন দেব। হয়তো আপনার জামার বরকতে তার কবরের আজাব মাফ হয়ে যাবে।’

আল্লাহর রাসুল (সা.), আমার রহমতের নবী, পৃথিবীর সবচে নরম দিলের মানুষটি কোনো রকম চিন্তা ছাড়াই দেরি করলেন না, তখনই নিজের জামাটি আবদুল্লাহর হাতে দিয়ে দিলেন। ভাবেন তো সে ছিল মুনাফেক ও কট্টর শয়তান। দয়া মায়া দেখালেন।

সাহাবির চোখ জলে ভরে উঠল। এমন দয়ার নবীকে তার বাবা কতভাবেই না কষ্ট দিয়েছে! রাসুলের জামা বুকে চেপে ধরে আবদুল্লাহ দৌড়ে বাবার লাশের কাছে চলে এল।

তারপর লাশের গোসল দিয়ে কাফন পরানো হলো!

এখনই মুনাফেক ইবনে উবাইয়ের জানাজা পড়ানো হবে। এমন সময় রাসুল এলেন সেখানে। ইবনে উবাইয়ের ছেলে রাসুল (সা.) কে দেখে দৌড়ে এসে লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে মিনতি করে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আব্বার জানাজাটা আপনি পড়াবেন?’ রাসুল একবারও চিন্তা করলেন না, একবারও ভাবলেন না আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের অতীত অপকর্মের ব্যাপারে, সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন, ‘হ্যাঁ, কেন নয়? অবশ্যই তার জানাজা পড়াব।’

রাসুল (সা.) সাহাবাদের জানাজা নামাজের কাতার সোজা করতে বললেন। এই হলো ক্ষমা প্রদর্শন।

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, নবীজী তার জানাজায় যেতে শুরু করল হুজুরের বুক বরাবর সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ তায়ালার দুশমন ইবনু উবাইর জানাজা কি আপনি আদায় করবেন, যে অমুক দিন এই কথা বলেছে, অমুক দিন এই কথা বলেছে?

মুসলিমদের অরক্ষিত রেখে যে ইহুদের ময়দান থেকে ৩০০ যোদ্ধা নিয়ে ভেগে গিয়েছিল।

যে রাসুলকে হত্যা করতে মদিনার ইহুদিদের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করেছিল। রাসুলকে মদিনা থেকে বের করে দিতে একের পর এক ষড়যন্ত্র করেছিল! মদিনার মুনাফেকদের নেতা, আম্মাজান আয়েশা (রা.)-এর ওপর মিথ্যা অপবাদ রটনাকারী।

এভাবে নির্দিষ্ট দিন তারিখ উল্লেখ করে বলতে লাগলাম!’

রাসুলুল্লাহ (সা.) মুচকি হাসি দিতে থাকলেন।

(ওমর বলেন) এমনকি আমি যখন নবীজিকে অনেক কিছু বললাম, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে ওমর! আমার সামনে থেকে সরে যাও। আমি তোমার চেয়ে বেশি জানি তার সম্পর্কে!

আমাকে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তুমি এদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর বা না কর, তবুও আল্লাহ তায়ালা তাদের কখনো ক্ষমা করবেন না।’ (সুরা আত-তওবা: আয়াত ৮০)

নবীজী বললেন, ‘তবুও আমি তার জানাজা পরে ক্ষমা চাইব যদি আল্লাহ মাফ করেন!’

এমনকি ৭০ বার তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেও, তবুও আল্লাহ তায়ালা তাদের কখনো ক্ষমা করবেন না।

(নবীজী বলেন) ‘আমি যদি জানতাম তাদের জন্য ৭০ বারের বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করে দেবেন, তাহলে আমি তাই করতাম।’

আর আজ আমরা ছোট মত পার্থক্য বা আলেমদের দ্বিমতের কারণে মুসলিমদের কটাক্ষ করে সুন্নি, ওয়াহাবী, আহলে হাদিস, বিদআতি, কুফরির ইত্যাদি ফতুয়া দিয়ে দেই কত সহজে! আবার কিছু লোক ভালো করে না জেনে নবীওয়ালা কাজ দাওয়াত ও তাবলীগের বিরোধিতা করে! অথচ নবীজী মুনাফেকের সঙ্গেও এত সুন্দর ব্যবহার করেছেন, আখলাক দেখিয়েছেন!

তিনি বলেছেন, ‘যে মানুষকে ভালোবাসতে জানে না, আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন না।’

তিনি আবার বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার উম্মতের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে, সে আমার উম্মত নয়।’

নবীজী ইবনে উবাইয়ের জানাজা পড়ালেন। জানাজা শেষে তাকে কবরে শোয়ানো হলো। রাসুল তার লাশের সঙ্গে কবর পর্যন্ত এলেন। লাশ কবরে শোয়ানোর পর মাটি দেয়ার শুরু হওয়ার পর কী মনে হতেই তিনি সাহাবাদের বললেন, ‘তার লাশটা একটু বাইরে উঠাও তো।’

মদিনার মুনাফেকদের নেতা ইবনে উবাইয়ের লাশ কবর থেকে আবার উপরে উঠানো হলো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের মুখের একটুখানি থুথু মোবারক পরম যত্নে ইবনে উবাইয়ের মুখে মেখে দিলেন, হয়তো এর বরকতে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন!

এটা দেখে ওখানে উপস্থিত ১০০ মুনাফেক কালেমা পরে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল!

নবীজী জানতো ওই জমানায় কে কে মুনাফেক কিন্তু প্রকাশ করেননি গোপন রেখে গেছেন! আর আমরা সেই নবীর উম্মত হয়ে মানুষের দোষ প্রকাশ করে দেই! অথচ আমার নবীর ব্যবহার কত সুন্দর ছিল, সুবহানআল্লাহ, আখলাক দেখে দলে দলে লোকে মুসলমান হয়ে যায়...

(বি: দ্রঃ পরে আয়াত অবতীর্ণ হয়, আল্লাহ তাঁর নবীকে মুনাফেক বা কাফেরের জানাজা পরতে মানা করেন)

একবার কিছু লোক আম্মাজান আয়েশা (রা.)-এর খেদমতে পর্দার আড়ালে হাজির হয়ে হুজুর পাক (সা.)-এর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলার জন্য আরজ করলেন ...

জবাবে তিনি তাদের বললেন, ‘তোমরা কি কোরআন শরীফ পড়ো নাই? আল্লাহর নবীর চরিত্র ছিল ঠিক কোরআনের মতো!’ অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আখলাক ছিল জীবন্ত কোরআন। (মুসনাদে আহমাদ: ২৫৮১৩)

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ