ল্লাহ তায়ালা কোরআন কারীমে বহু বিষয় উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন। মানুষের চারপাশের এমন স্পষ্ট বিষয়ের মাধ্যমে উপমা দেয়া হয়েছে, যা বলামাত্রই আলোচ্য বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায়। তেমনই একটি উপমা কোরআনের এ আয়াত— ‘যারা আল্লাহকে ছেড়ে অন্য অভিভাবক গ্রহণ করেছে, তাদের দৃষ্টান্ত হলো মাকড়সা, যে নিজের জন্য ঘর বানায় আর নিশ্চয়ই ঘরের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দুর্বল মাকড়সার ঘরই হয়ে থাকে। আহা, তারা যদি জানত!’ (সুরা আনকাবূত: ৪১)
এ আয়াতে উপমার মূল ক্ষেত্র হলো ওই কাফেররা, যারা আল্লাহর বিপরীতে দুর্বল বরং মিথ্যা ও ক্ষমতাহীন উপাস্যদের তাদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করেছে, আল্লাহর পাকড়াওয়ের সামনে কাফেরদের রক্ষার যাদের কোনো শক্তিই নেই।
যেহেতু পৃথিবীর বড় বড় জালেম ও দাম্ভিক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আলোচনার পর পরই এ উপমা দেয়া হয়েছে, যারা মনে করত, তাদের শক্তি অপ্রতিরোধ্য এবং তাদের নিরাপত্তা বলয় দুর্ভেদ্য; এ বিবেচনায় এ উপমায় আরেকটি দিকও ভাবা যায়। তা হলো, দুর্বল এ জালের প্রতি হয়তো মাকড়সার থাকে অতিরিক্ত আস্থা ও ভরসা। এমনকি তা নিয়ে সে দম্ভ-অহংকার করে এবং আত্মপ্রবঞ্চিত হয়।
মাকড়সা হয়তো মনে করে, তার জাল সুপরিকল্পিত ও সুগঠিত। সুকৌশলে নির্দিষ্ট মাপের বুননে তৈরি। মজবুত অবকাঠামোতে সুনিপুণভাবে স্থাপিত তার জাল। এ ভেদ করার ক্ষমতা নেই কারো।
সে হয়তো ধোঁকার শিকার হয়, যখন দেখে- মশা, মাছি, কীটপতঙ্গ তার জাল ভেদ করতে পারে না। তার জালের কাছে এলে রেহাই নেই কারো। জালের ঠিক মাঝখানে অবস্থান করে চারপাশে আটকে পড়া পোকামাকড় দেখে সে দাম্ভিক হয়ে ওঠে। সে ভাবে, এখন এরা আমার কব্জায়; এদের নিস্তার নেই; আমি চাইলেই এদের ঘাড় মটকে দিতে পারি, কুড়ে কুড়ে খেতে পারি তাদের দেহ-অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। আর আমার এ জাল কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়; এ চিরঅক্ষয়! কিন্তু যেদিন সময় আসে। বাড়ির মালিকের যেদিন জাল অপসারণের অভিপ্রায় হয়, নরম ঝুল-ঝাড়ুর সামান্য ছোঁয়ায় লন্ডভন্ড হয়ে যায় সুপরিকল্পিত ও সুগঠিত এ দম্ভ-জাল। জালের সঙ্গে সঙ্গে সাঙ্গ হয় দাম্ভিক মাকড়সা ও তার দম্ভ!
যাই হোক, আলোচ্য আয়াতের এ উপমার আগে সুরার ২৮ নম্বর আয়াত থেকে আল্লাহ জালেম ও দাম্ভিক বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর পরিণতির বর্ণনা দিয়েছেন— ‘কওমে আদ, যারা বলেছিল- ‘শক্তিতে আমাদের ওপরে কে আছে?’ কওমে লূত, যারা দম্ভ করে বলেছিল- ‘তুমি যদি সত্যবাদী হও, তবে আমাদের ওপর আল্লাহর আজাব নিয়ে এসো দেখি।’ এভাবে কওমে ছামূদ, কওমে ইবরাহীম, কওমে শুআইবের আলোচনার পর উপমার একেবারে আগের দুই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা কারূন, ফিরাউন ও হামানের মতো বড় বড় জালেমের আলোচনা করেছেন- কীভাবে সেসব জালেমকে তিনি ধ্বংস করেছেন, যারা ছিল অতি দাম্ভিক ও আত্মপ্রবঞ্চিত। যারা মনে করেছিল, তাদের এ দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা বলয় ভাঙার ক্ষমতা নেই কারো। যারা ভেবেছিল, তাদের রাজত্ব চিরকালই অক্ষয়।
কোরআনের ভাষায় পড়ুন তাদের পাকড়াওয়ের কথা- আমি কারূন, ফিরাউন ও হামানকে ধ্বংস করেছিলাম। মূসা তাদের কাছে উজ্জ্বল নিদর্শন নিয়ে এসেছিল, কিন্তু তারা দেশে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল, কিন্তু তারা তো (আমার ওপর) জিততে পারেনি। আমি তাদের প্রত্যেককে তার অপরাধের কারণে পাকড়াও করেছি। তাদের কেউ তো এমন, যার বিরুদ্ধে পাঠাই পাথর বর্ষণকারী ঝড়ো-ঝঞ্ঝা, কেউ ছিল এমন, যাকে আক্রান্ত করে মহানাদ, কেউ ছিল এমন, যাকে ভূগর্ভে ধসিয়ে দেই এবং কেউ ছিল এমন, যাকে করি নিমজ্জিত। বস্তুত আল্লাহ এমন নন যে, তাদের প্রতি জুলুম করবেন; বরং তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করছিল। (সুরা আনকাবূত: ৩৯-৪০)
এ দৃষ্টান্ত দেয়ার পর কোরআন কত হূদয়গ্রাহী ভাষায় আহ্বান করেছে সব জালিমকে এ উপমা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে এবং তার জুলুম ও আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে ফিরে আসতে— ‘আমি মানুষের কল্যাণার্থে এসব দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকি, কিন্তু তা বোঝে কেবল তারাই, যারা জ্ঞানবান।’ (সুরা আনকাবূত: ৪১)
জালেমের পরিণতি বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন— ‘যারা জুলুম করেছে, তারা অচিরেই জানতে পারবে- কোন পরিণামের দিকে তারা ফিরে যাচ্ছে।’ (সুরা শুআরা: ২২৭)
মাজলুমদের প্রতি আল্লাহর সান্ত্বনা— ‘তুমি কিছুতেই মনে করো না, জালেমরা যা কিছু করছে আল্লাহ সে সম্পর্কে বেখবর। তিনি তো তাদেরকে সেই দিন পর্যন্ত অবকাশ দিচ্ছেন, যেদিন চক্ষুসমূহ থাকবে বিস্ফোরিত। তারা মাথা ওপর দিকে তুলে দৌড়াতে থাকবে। তাদের দৃষ্টি পলক ফেলার জন্য ফিরে আসবে না। আর (ভীতি-বিহ্বলতার কারণে) তাদের প্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম হবে।’ (সুরা ইবরাহীম: ৪২-৪৩)
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ