ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলকদ ১৪৪৫

‘মানব ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কিত বিশ্ব সভায় ড. ইউনুসের অংশগ্রহণ কতটা যুক্তিসঙ্গত?’

প্রকাশনার সময়: ১০ মে ২০২৪, ২১:২৯ | আপডেট: ১০ মে ২০২৪, ২১:৪৬

ব্যক্তিগতভাবে অর্থনীতিবিদ হলেও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন সময়ে রয়েছেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ২০০৬ সালে নোবেল পাওয়ার পর ওয়ান-ইলেভেনে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার সময় রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যর্থ চেষ্টা, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ স্থাপনা পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধে বিশ্ব ব্যাংককে প্রভাবিত করা, বয়স না থাকলেও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদ আঁকড়ে রাখতে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া, গ্রামীণ ব্যাংক ছেড়ে সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হওয়া, শ্রম আইন অনুসরণ না করে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরে চাকরিচ্যুত এবং শ্রমিকদের লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করা এবং মামলায় হেরে যাওয়ার আশঙ্কায় আদালতের বাইরে সেটেলমেন্টসহ এমডি থাকাকালীন রাষ্ট্রীয় বিধি বহির্ভূতভাবে বিদেশ ভ্রমণের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।

এসব অভিযোগের বিপরীতে আদালতে মামলা এবং তার সত্যতা প্রমাণের ভিত্তিতে আদালতের রায়ে ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং অর্থেদণ্ডিত ড. ইউনূস এখন আইনের দৃষ্টিতে একজন অপরাধী এবং বাংলাদেশসহ বিশ্ব সমাজের বসবাসরত নাগরিকদের চোখে একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। মুখে দেশপ্রেমের কথা বলে দেশের সাধারণত মানুষকে ব্যবহার করে এবং তারে শুষে নিয়ে নিজের গড়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার সম্প। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী তকমাদারী ড. ইউনূসের আচরণ এবং কর্মকাণ্ডে কখনোই মানবাধিকার কোনো ছাপ ছিলো না। বাংলাদেশে যখনই কোনো ধরনের রাজনৈতিক বা সামাজিক সংকট তৈরি হয়েছে তখনি তিনি বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়েছেন। করেছেন অযাচিত হস্তক্ষেপ, যা অনেক সময় বাংলাদেশের মতো একটি দেশের সার্বভৌমত্বের উপর হুমকিস্বরূপ।

সম্প্রতি ফ্রেটেলি তুট্টি ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত মানব ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কিত বিশ্ব সভার নতুন সংস্করণটি ১১ মে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফ্রেটেলি তুত্তি ফাউন্ডেশনের সভাপতিত্ব করছেন কার্ডিনাল মাউরো গাম্বেত্তি, যিনি সেন্ট পিটারের পাপাল ব্যাসিলিকার আর্চপ্রিস্ট এবং ভ্যাটিকান সিটির জন্য পোপের ভিকার। মানব ভ্রাতৃত্বের এই বিশ্ব সভার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘ভাতৃত্বের জন্য আইডিয়া এবং এনকাউন্টারস, আসুন আমরা একসাথে শান্তির বিশ্ব গড়ে তুলি।

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী, আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান, ব্যবসা, একাডেমিয়া, বিজ্ঞান এবং সুশীল সমাজের বিশ্বের নেতৃবৃন্দসহ আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের একটি বড় দল ইটারনাল সিটিতে আলোচনা ও বিস্তৃত প্রস্তাবগুলি নিয়ে আলোচনা করতে মিলিত হবে। বিশিষ্ট প্রতিনিধিরা শান্তি, টেকসই উন্নয়ন, সামাজিক অর্থনীতি, শিক্ষা, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, শালীন কাজ এবং মানবতার সাধারণ কল্যাণের সাথে সম্পর্কিত আরও অনেক বিষয়ে সাক্ষাত করবেন এবং কথা বলবেন।

তবে অবাক করার বিষয় হলো প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বাংলদেশের একমাত্র নোবেল লরেটও এই কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন। মানব ভ্রাতৃত্ব সভায় ড. ইউনূসের এই অংশগ্রহণ একটি বড় প্রশ্ন চিহ্ন রাখে। এখানে ভাবনার বিষয় হচ্ছে ইউনূসের মতো একজন বিতর্কিত ব্যক্তি কীভাবে সেই বৈঠকের অংশ হন যেখানে প্রতিনিধিরা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজের কথা বলবেন। নোবেল শান্তি পুরস্কার লরেট হিসাবে ড. ইউনূস মিটিং এর অংশ নিতে যাচ্ছেন। কিন্তু এটি কি তার সমস্ত বিতর্কিত কাজকে ধুয়ে দিতে পারবে?

মোহাম্মদ ইউনূস একজন বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান ব্যক্তি এবং প্রায়শই বিভিন্ন প্রোগ্রামে আমন্ত্রিত হন। তবে, এবার এই প্রোগ্রামে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অংশগ্রহণ ব্যতিক্রম কারণ ড. ইউনূস শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে শ্রম আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে এ কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন। গত ২ জানুয়ারি, ২০২৪-এ, ইউনূস এবং গ্রামীণ টেলিকমের অন্য তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যদিও শীঘ্রই জামিন মঞ্জুর করা হয়েছিল। বর্তমানে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আদালতে দেড় শতাধিক মামলা বিচারাধীন। বেশিরভাগ মামলা শ্রম আইন লঙ্ঘন, বেতন না দেওয়া এবং শ্রমিকদের কম বেতনের সাথে সম্পর্কিত। এসব মামলা নিজের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা দায়ের করেন। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনও ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও লভ্যাংশ না দেওয়ার অভিযোগে অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছিল।

এটা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে, ইউনূস হলেন ক্ষুদ্রঋণ এবং সামাজিক ব্যবসায়িক মডেলের পথপ্রদর্শক, যা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বৈশ্বিক পর্যায়েও দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করেছে। তার মডেল অনেক উন্নত পশ্চিমা দেশগুলির পাশাপাশি ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলি গ্রহণ করেছিল। তবে যদিও মডেলটি দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য আকর্ষণীয় ছিল কিন্তু ইউনূস এটির অপব্যবহার করেছিলেন এবং নিজের সুবিধার পক্ষে ব্যবহার করেছিলেন। যার ফলে ঐ মডেল হয়ে ওঠে তার ব্যাপক মাত্রায় নিপীড়নের হাতিয়ার। ড. ইউনূস বাংলাদেশে একজন মহাজন ও অত্যাচারী ব্যক্তি হিসেবে জনসাধারণের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত। দারিদ্র্য বিমোচনের পরিবর্তে তিনি সফলভাবে দারিদ্র্যের ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশে। মানবতাকে পদদলিত করে দারিদ্র্য ব্যবসায়ী হয়ে উঠা এমন একজন ব্যক্তি কিভাবে মানব ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কিত বিশ্ব সভার অংশগ্রহণের সুযোগ পায় তা কোনভাবেই বোধগম্য নয়।

শান্তি প্রচারের নামে ড. ইউনূস শ্রমিক শোষণ, অসততা, আর্থিক তথ্য গোপন ও কর ফাঁকির উদাহরণ তৈরি করেন। এ ব্যাপারে ড. ইউনূস সবসময়ই বেশ কিছু পশ্চিমা নেতার সমর্থন পেয়েছিলেন, যারা ড. ইউনূসের বন্ধু ও সহকর্মী হিসেবে পরিচিত। তারা প্রায়ই ড. ইউনূসের সমর্থনে খোলা চিঠি লেখে, ইউনূসকে সরকারের টার্গেটেড হয়রানির শিকার বলে উল্লেখ করে। ফলস্বরূপ, ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের বিষয়ে ইউনূসের অবস্থান সবসময় পশ্চিমা নেতারে অবস্থানের সাথে মিলে যায়। বিশ্ব শান্তির দূত হওয়া সত্ত্বেও ড. ইউনূস কখনো গাজায় চলমান গণহত্যার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে পুরো বিশ্ব যেখানে সরব সেখা তিনি কোনো ধরনের নিন্দা করেননি। অন্যদিকে, গাজায় চলমান যুদ্ধের মধ্যে ড. ইউনূস ইসরায়েলে জন্মগ্রহণকারী ভাস্কর হেদভা সেরের কাছ থেকে 'ট্রি অফ লাইফ' পুরস্কার নামে একটি পুরস্কার পেয়েছিলেন, যিনি ইউনেস্কোর একজন শুভেচ্ছা দূত।

অথচ, ড. ইউনূস এই পুরস্কার নিয়ে ভুয়া বক্তব্য ছড়িয়েছেন। ড. ইউনূস তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দাবি করেছেন যে তিনি ইউনেস্কো থেকে 'ট্রি অফ লাইফ' পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ড. ইউনূসকে গজনভী সেন্টার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। ইউনেস্কোর সদর দপ্তর তখন নিশ্চিত করে যে সংস্থাটি ড. ইউনূসকে এ ধরনের কোন সম্মান প্রদান করেনি। বাংলাদেশের মানুষ ড. ইউনূসকে মিথ্যার জালের মধ্য দিয়ে দেখে। একজন হিতৈষী বহিরাগত একজন দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের সাথে লড়াই করার তার বর্ণনা একটি বিপজ্জনক বানোয়াট।

এখানেই শেষ নয়, ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর অধীনস্থ সংস্থাগুলিতে তার আর্থিক অব্যবস্থাপনাকে ঢাকতে সরকারি নিপীড়নের একটি গল্প ঘোরান। চলমান আদালতের মামলাগুলি রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় বরং সেগুলি আর্থিক বিধিবিধানের প্রতি তার অবহেলার পরিণতি। গ্রামীণ ব্যাংকে বছরের পর বছর ধরে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কারণে তার জবাবদিহিতার অনুভূতি নষ্ট হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তার সরকারি হস্তক্ষেপের দাবিও সমান প্রতারণামূলক। গ্রামীণ ব্যাংক তার শৈশবে যে উদার সহায়তা পেয়েছিল তা সুবিধাজনকভাবে সে ভুলে গেছে। এখন, যখন বেসিক ট্যাক্স রেগুলেশন মেনে চলতে বলা হয়, তখনই ড. ইউনূস কেঁদে ফেলেন। এটি রিদ্রদের জন্য একজন চ্যাম্পিয়নের আচরণ নয় বরং আইনের ঊর্ধ্বে কাজ করতে অভ্যস্ত ব্যক্তির আচরণ।

এ ছাড়াও, বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগ উন্মোচন করেছিলেন তথাকথিত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস। তিনি তার পশ্চিমা লবিস্ট ব্যবহার করে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। বিশ্ব ব্যাংক তখন এই প্রকল্পে অর্থায়ন ডেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়, যা এখন বাংলাদেশের লাখো মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের পথিকৃৎ হয়ে উঠেছে। তার আইনি মেয়াদ অতিক্রম করে গ্রামীণ ব্যাংকে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্তকে আমরা যেন ভুলে না যাই। নিয়ন্ত্রণ ত্যাগ করার অনিচ্ছা তার প্রকৃত অগ্রাধিকার সম্পর্কে ভলিউম কথা বলে। বিশ্ব মঞ্চে তার নিজের দেশের গৌরব তুলে ধরার কথা ছিল। এটি করার পরিবর্তে, তার নিজের দেশ সম্পর্কে তার ঘন ঘন ম্যিা তার খ্যাতি এবং বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা ম্লান করে দেয়। ফলস্বরূপ, শান্তি, টেকসইতা এবং ন্যায্য শ্রম অনুশীলনের বিষয়ে বৈশ্বিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পিত একটি সমাবেশ, ভ্রাতৃত্ব সভায় ইউনূসের অন্তর্ভুক্তি শুধু প্রোগ্রামের সুনামই নষ্ট করবে না বরং তার উপস্থিতি সম্ভবত এই বিশ্ব সভার বৈধতার ওপর ছায়া ফেলবে।

সুতরাং, ফ্রেটেলি তুট্টি ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত মানব ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কিত এই বিশ্ব সভায় ড. ইউনূসের মতো মানবিকতা বিবর্জিত, স্বাধীন বাংলাদেশের আইন দ্বারা দণ্ডিত এবং তার নিজের বিভিন্ন ধরনের আচরণ ও কর্মকাণ্ড দ্বারা বিতর্কিত এমন একজন মানুষের অংশগ্রহণ কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। এমন বিতর্কিত একজন ব্যক্তির অংশগ্রহণ মানব ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কিত এই বিশ্ব সভার নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এমতাবস্থায়, উক্ত সভার সফলতার লক্ষ্যে আমার মনেহয় ফ্রেটেলি তুট্টি ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের উচিত ছিলো সব ধরনের যাচাই-বাছাই করে বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এমন ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ এই সভায় নিশ্চিত করা। তখনই কেবল ড. ইউনূসের মতো এমন বিতর্কিত কোনো ব্যক্তির অংশগ্রহণ মানব ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কিত এই বিশ্ব সভায় সম্ভব হতো না এবং সভা নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্ক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা হতো না।

উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবেক চেয়ারম্যান ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ