ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলকদ ১৪৪৫

সমাজ ও মানুষের মনের দর্পণ বেতার

বিশ্ব বেতার দিবস
প্রকাশনার সময়: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:৩৬

১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এ দিবসের লক্ষ্য হচ্ছে সবার মধ্যে বেতারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদেরকে বেতারের মাধ্যমে তথ্য সুলভ্যতা নিশ্চিত করা এবং বেতার সম্প্রচারকদের মধ্যবর্তী আন্তর্জাতিক সহায়তা ও পারস্পরিক মতামত ও তথ্য বিনিময় জোরদার করা।

ইউনেস্কো প্রতিবছর সারা বিশ্বের সম্প্রচারক, সংস্থা এবং সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় বেতার দিবস উপলক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। জানা যায়, প্রথমবার ২০১০ সালে স্পেন রেডিও সংস্থার পক্ষ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস উদযাপন করার প্রস্তাব আসে। এরপর ২০১১ সালে এটি ইউনেস্কোর সদস্য দেশগুলো ঘোষণা করে এবং ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো প্রথম এ দিনটি বিশ্ব বেতার দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে।

মূলত চারটি ধারায় রেডিও সম্প্রচার করে থাকে। যথা- পাবলিক সার্ভিস, আন্তর্জাতিক রেডিও, বাণিজ্যিক রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিও। পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ বেতার যেমন অনুষ্ঠান ও খবর সম্প্রচার করছে; তেমনি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, ভয়েস অব আমেরিকা, এনএইচকে, রেডিও তেহরান, রেডিও চায়না ও অন্যান্য বিদেশি মাধ্যমেও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে পারছি। আবার দেশে সাম্প্রতিককালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সম্প্রচার করছে শহরভিত্তিক বেসরকারি এফএম রেডিও। সব মিলিয়ে বেতারের প্রচার দিনে দিনে প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশে কমিউনিটি রেডিওর সাফল্যও অনেক।

আমাদের অনেকেরই ধারণা ইন্টারনেটের অগ্রযাত্রার এ সময়ে রেডিও তার গুরুত্ব হারিয়েছে। ধারণাটি মোটেও সঠিক নয়। কারণ সময় যেমন বদলেছে, ঠিক তেমনই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রচারণার ধরনও বদলে গেছে। এখনো বহু মানুষ বেতার শোনে। এখনেও অনেক মানুষ বেতারের ওপর নির্ভর করে। সারা বিশ্বে বেতার এখনো অন্যতম জনপ্রিয় গণমাধ্যম। বেতারের রয়েছে পৃথিবীর দুর্গম স্থানে পৌঁছানোর শক্তি। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রসারের ফলে সম্প্রচার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিযোগিতাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। গ্রামগঞ্জ ও দুর্গম এলাকায় এখনো বেতার তথ্য আদান-প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম।

আমরা হয়তো অনেকেই জানি, মার্কনি বেতারের আবিষ্কারক কিন্তু সাম্প্রতিক এক তথ্যে জানা যায়, বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র্র বসু মার্কনির আগেই বেতার আবিষ্কার করেছিলেন। এ তথ্যটি প্রকাশ করেছেন খোদ মার্কনির নাতি পারসেশচে মার্কনি যিনি নিজে ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরির একজন জ্যেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ।

কারণ ১৯০১ সালে মার্কনি আটলান্টিকের ওপারে প্রথম বেতার সংকেত পাঠান এবং পাল্টাসংকেত গ্রহণ করেন কিন্তু এর আগেই ১৮৯৯ সালে মার্কনি বাংলার জগদীশ চন্দ্র্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বসুই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি রেডিও এবং মাইক্রো ওয়েভসের অপটিক্সে নিয়ে কাজ করেছিলেন। ১৯১৮ সালে লি দ্য ফরেস্ট নিউইয়র্কের হাইব্রিজ অঞ্চলে বিশ্বের প্রথম রেডিও স্টেশন শুরু করে। তবে পুলিশ এটিকে অবৈধ বলেছিল এবং এটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। পরে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, স্যার অলিভার লজ এবং আলেক্সান্ডার প্যাপোভ বেতারের উন্নয়ন ও বিকাশে ব্যাপক অবদান রাখেন। ১৯৩৬ সালে ভারতে অফিসিয়াল ‘ইম্পেরিয়াল রেডিও’ শুরু হয়েছিল যা স্বাধীনতার পরে অল ইন্ডিয়া রেডিও নামে পরিচিতি পায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে বেতারের যাত্রা শুরু ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর।

আসলে বেতার এমন একটি গণমাধ্যম পৃথিবীতে যার ব্যাপ্তি অন্য সব গণমাধ্যম অপেক্ষা অনেক বেশি। এটি একাধারে যোগাযোগের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার এবং সাশ্রয়ী মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। দূরবর্তী জনসম্প্রদায় ও ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের কাছে (নিম্ন সাক্ষরতার হারবিশিষ্ট জনসম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, নারী, তরুণ-তরুণী এবং দারিদ্র্যের শিকার ব্যক্তি) পৌঁছাতে বেতারের কোনো বিকল্প নেই। একইসঙ্গে এটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার স্তর নির্বিশেষে জনবিতর্কে মানুষের অংশগ্রহণের একটি মঞ্চ।

অধিকন্তু, জরুরি অবস্থাকালীন যোগাযোগ ও বিপর্যয়কালীন ত্রাণকর্মে বেতার একটি শক্তিশালী ও নির্দিষ্ট ভূমিকা রাখে। বর্তমানে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সমধর্মিতা হওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে, তাই বেতার সেবাগুলোও প্রযুক্তির নতুন নতুন রূপের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, মুঠোফোন, এফএম, কমিউনিটি ও ট্যাবলেটে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। এত কিছু সত্ত্বেও বিশ্বের প্রায় শত কোটি লোকের কাছে এখনো বেতার সেবা সহজলভ্য নয়।

সংবাদপত্র যদিও সবচেয়ে পুরাতন গণমাধ্যম কিন্তু এক সময় শহর বন্দর গ্রাম সর্বত্রই প্রচার মাধ্যমের আভিজাত্যই ছিল বেতার। গল্প, উপন্যাস, নাটক এমনকি সিনেমায় নায়ক-নায়িকাদের দেখা যেত তারা বেতারে গানের রেকর্ডিং করছেন। সেই গান শুনছেন দেশের হাজারও মানুষ ও অগণিত শ্রোতা। কী যে সেই আকুলতা ও আগ্রহ! কখন শুরু হবে সেই প্রিয় নাটক কিংবা সিনেমার গান। বেতারে প্রোগ্রাম করা মানেই শিল্পীর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে যাওয়া। তখন বেতারই ছিল সাধারণ মানুষের আনন্দ বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। টেলিভিশন ছিল কিন্তু তার গণ্ডি ছিল হাতেগোনা মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের ড্রয়িংরুমে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন শোভা পেত ঠিকই, কিন্তু তাও আবার হাতেগোনা কিছু মানুষের কাছে এবং টেলিভিশনের আবেদন থাকত মাত্র কয়েক ঘণ্টা।

ইদানিং যেমন পরিবারের অধিকাংশ সদস্য ব্যস্ততা সত্ত্বেও টেলিভিশনে সন্ধ্যা ও দুপুরের খবর দেখতে ভুল করেন না। তেমনি রেডিওর সেই যুগে শ্রোতারা সন্ধ্যার এবং দুপুরের খবর বেশ আগ্রহভরে শুনত। চায়ের দোকানে রেডিওতে খবর শুনতে মানুষ ভিড় করত। দুর্যোগ প্রতিরোধে রেডিওর খবরই ছিল মূল ভরসা।

মোট কথা সংবাদপত্রের পাশাপাশি রেডিও, একমাত্র রেডিওই ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রচার মাধ্যম। এখনো গান, খবর, নাটকের পাশাপাশি জনসংখ্যা সমস্যা, বাল্যবিয়ে রোধসহ নানা বিষয়ে নাটক/নাটিকা প্রচার হয়। শ্রোতারা ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে সেসব শুনে। খবরের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা জরুরি। রেডিওর খবর এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। বিশেষ করে বিভিন্ন দুর্যোগ, খেলাধুলা কিংবা ব্রেকিং নিউজ শোনার জন্য রেডিওতে কান পেতে রাখে। রেডিওতে দেশের মানুষ চরম সংকটেও এগিয়ে চলার প্রেরণা খুঁজে পায়।

আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে দেশের অসহায় মানুষকে উজ্জীবিত করার কাজে রেডিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট নামে খ্যাত ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের এক বলিষ্ঠ প্রচার কাণ্ডারি।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত কালজয়ী গান ও অনুষ্ঠানগুলো একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে শক্তিশালী করেছে, অন্যদিকে দেশের জনগণকে স্বাধীনতার দিকে অনুপ্রাণিত করেছে। শুধু কী তাই, মানুষের জীবনে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, মহামারিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রকৃত বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ বেতার। এখনো বাংলাদেশ বেতার অবিরাম তথ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে।

তবে সেই রেডিও এখন আর সচরাচর দেখা যায় না। তবে একদম হারিয়ে যায়নি। এখনো অনেক মানুষ রেডিও শোনে। তাদের অধিকাংশই স্বাধীনতার আগের প্রজন্ম। নতুন প্রজন্ম অবশ্য এফএম, ইন্টারনেট বা স্মার্টফোনে রেডিও শুনতে অভ্যস্ত। রেডিও আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। অনেকে মনে করেন, দেশে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সংখ্যা যতই বাড়ছে, দিন দিন রেডিওতে শ্রোতার সংখ্যা ততই কমছে।

অনেক আন্তর্জাতিক রেডিও ইতোমধ্যে সর্টওয়েবে প্রচার বন্ধ করে শুধু ডিজিটাল মাধ্যম ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব আছে। এ কারণে এক সময় রেডিওর ভূমিকা যেন অনেকটাই ম্রিয়মাণ হয়ে ওঠে। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী রেডিওকে এখনো ধরে রেখেছেন গ্রামবাংলার মানুষ ও শ্রোতারা, তাদের কেউ কেউ মিলে গড়ে তুলেছেন রেডিও শ্রোতা ক্লাব। শ্রোতা ক্লাবগুলো শুধু নিজেদের মধ্যে নয়, তারা আন্তর্জাতিক বেতারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, নানা সমাজ সচেতনতামূলক কাজ করছে। মূলত তারাই গণমাধ্যমের পুরাতন মাধ্যম রেডিও বাঁচিয়ে রেখেছেন।

সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে গণমানুষকে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করতে বেতার শক্তিশালী হাতিয়ার। এ ছাড়াও জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ সম্পাদন করা এবং দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় বেতারের ভূমিকা অনন্য। তারবিহীন যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলো বেতার বা রেডিও। সবচেয়ে প্রাচীন, সহজলভ্য ও একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে বেতার পৃথিবীব্যাপী বহুল পরিচিত।

প্রবল প্রযুক্তিনির্ভর এ সমাজেও বেতার তার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা ধরে রেখে এগিয়ে চলছে। সহজলভ্যতা এবং বহনযোগ্যতার কারণেই বিশ্বব্যাপী বেতার সগৌরবে টিকে আছে এবং সার্বজনীন গণমাধ্যম হিসেবে থাকবেও অনন্তকাল। ইন্টারনেট লাইভ স্ট্রিমিং এবং ফেসবুক, ইউটিউব অডিও-ভিডিও লাইভ শোনা-দেখার সুবিধা থাকায় সব শ্রেণির শ্রোতার কাছেই পৌঁছে যাচ্ছে আজকের বেতার। বেতারকে বলা হয় মানুষ ও সমাজের দর্পণ কারণ সমাজের এমন কিছু নেই যা বেতারে তুলে ধরা হয় না। মানুষ ও সমাজের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার প্রতিচ্ছবি হচ্ছে বেতার। এ কারণে পুরাতন গণমাধ্যম হিসেবে রেডিওকে বাঁচিয়ে রাখা শ্রোতা ও পাঠকদের দায়িত্ব।

লেখক: ব্যাংকার ও কালাম লেখক

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ