মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১

উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে ডেঙ্গু

প্রকাশনার সময়: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৭

ডেঙ্গুজ্বর প্রতিনিয়ত ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এতে জনজীবনে শুরু হয়েছে হতাশা। কোনো সঠিক পদক্ষেপ পাচ্ছে না জনসাধারণ। দেশে প্রতিবছর ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, মৃত্যুহার বেড়ে চলেছে। মৃত্যুর এই উচ্চ হার বিশ্বের আর কোথাও নেই। অভিযোগ উঠেছে, সমস্যা মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। দেশব্যাপী জোরদার প্রতিরোধ কার্যক্রম তেমন চোখে পড়ছে না। এডিস মশার বিস্তার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে, আগামী মাসে ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ রূপ নেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গায়ে প্রচণ্ড জ্বর আর শরীর ব্যথা নিয়ে প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছেন ডেঙ্গু রোগী। এতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৮ হাজার ৫৬৫ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৫০ জন। এর মধ্যে গত আট দিনেই (২২-২৯ সেপ্টেম্বর) ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।

গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত (একদিনে) ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু নিয়ে চলতি বছরের রেকর্ড এক হাজার ২২১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর এ নিয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৭৮৬ জনে। এ সময় নতুন করে আরো আট জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি এ বছরের সর্বোচ্চ। এ নিয়ে চলতি বছরে মশাবাহিত রোগটিতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫৮ জনে।

গতকাল রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ জন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা। এছাড়া ঢাকা উত্তর, বরিশাল ও খুলনা বিভাগে একজন করে মারা গেছেন। ফলে চলতি বছরে মশাবাহিত রোগটিতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৮ জনে।

আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ৪৩৪ জন রয়েছেন। এছাড়া ঢাকা বিভাগে ২৬৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৮৩ জন, বরিশাল বিভাগে ৭৪ জন, খুলনা বিভাগে ১৩৪ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৮ জন, রাজশাহী বিভাগে ৫৩ জন এবং রংপুর বিভাগে ২৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ২৯ হাজার ৭৮৬ জন। যাদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৯০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ দশমিক ১০ শতাংশ নারী। এছাড়া এখন পর্যন্ত মৃত ১৫৮ জনের মধ্যে ৫১ দশমিক ৩০ শতাংশ নারী এবং ৪৮ দশমিক ৭০ শতাংশ পুরুষ রয়েছেন।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক আহমেদ বলেন, ‘প্রথমত রোগীর সংখ্যা বাড়লে আনুপাতিক হারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। দ্বিতীয়ত গত বছর সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে যেসব কারণ সেগুলো কিন্তু এখনো দূর হয়নি। যেমন, চিকিৎসা ব্যবস্থা যেটা আছে আমাদের সেটা বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। এছাড়া যারা শনাক্ত হচ্ছে কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ রোগী নয়, তাদের মাঠপর্যায়ে হাসপাতালে রাখার কথা, আবার যারা জটিল রোগী তাদেরও একসঙ্গে রাখা হচ্ছে, ফলে তারা যথার্থ চিকিৎসা পাচ্ছে না। সব এক জায়গায় হওয়ার কারণে ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না। কাজেই চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করা খুব দরকার।’

সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘ডেঙ্গু রোগীদের সামাল দিতে গিয়ে অন্য রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থায় সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।’

ডেঙ্গু চিহ্নিত শত্রু, তারপরও তা দমন করা যাচ্ছে না। এডিস মশা নির্মূল করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টরা। গত ২৪ বছরেও পুরোনো রোগটি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। উলটো এটি আরো শক্তিশালী হচ্ছে।

জানা যায়, এডিস মশা দেশের প্রতিকূল জলবায়ুর সঙ্গে টিকে থাকার সক্ষমতাও অর্জন করতে শুরু করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এডিসের উৎপাত শুধু বর্ষাকালে নয়, বছরজুড়েই থাকবে। কাজেই ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে সারা বছর মশক নিধনসহ অন্যান্য কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। যেভাবেই হোক ডেঙ্গুর উৎস পুরোপুরি নির্মূল করতে হবে।

চিকিৎসকরা জানান, এবার নতুন কিছু উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। অনেকের প্লাটিলেট দ্রুত নেমে যাচ্ছে। দ্রুত সময়ে হাসপাতালে না আসায় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি।

রোগীদের অভিযোগ, রাজধানীর অনেক এলাকাতেই মশা নিধনের ওষুধ ঠিক মতো দেওয়া হচ্ছে না। স্প্রে করার কিছুক্ষণ না যেতেই শুরু হয় মশার উপদ্রব।

মহাখালী ডিএনসিসি ডেঙ্গু বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিচালক জানান, চলতি মাসের ১০ তারিখ থেকে পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবাইকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে।

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম জানান, ডেঙ্গু বিষয়ে আগে যেসব পরিকল্পনা করা ছিল, সে অনুযায়ীই কাজ করছেন তারা। কাউন্সিলর না থাকার কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি শিগগিরই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আসছে অক্টোবরে আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে ডেঙ্গুর প্রকোপ। বিশেষ করে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশ কিছু জেলা উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। বিশেষ করে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে সৃষ্ট ঘনবসতি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ চোখ রাঙাচ্ছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের দিকে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ড. আতিকুর রহমান জানান, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিরোধক ওষুধ ব্যবহারের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনে পক্ষ থেকে সব জায়গায় প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। একই সঙ্গে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর চৌধুরী বলছেন, মশানিধনে শুধু জেল-জরিমানা আর জনসচেনতনা বাড়িয়ে কাজ হবে না। সঠিকভাবে জরিপ চালিয়ে দক্ষ জনবল দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রতিবছরই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্টদের দায়ী করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা এর দায়িত্বে রয়েছেন তারা এটাকে চাকরি হিসেবে দেখছে, সেবা ও ভালোবাসার আন্তরিকতাপূর্ণ সহাবস্থানের অনুপস্থিতিও ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। একই সঙ্গে রোগীর অসচেতনতা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু রোগীর যথাযথ চিকিৎসা না করেই অন্য হাসপাতালে রেফার করা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের দুর্বলতা প্রতিবছরই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘একটি ডেঙ্গু রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই চিকিৎসা দিতে পারে। অথচ তা না করে জেলা হাসপাতালে ট্রান্সফার করে বা বিভাগীয় হাসপাতালে ট্রান্সফার করে দেয়। এতে যে টাইম লাগে এতে রোগীর প্লাজমালি কেইস হয়ে যায়, প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যায়। কমে গিয়ে এই রোগীটির অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।’

প্রতি বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গেল বছর দেশে তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন।

আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন তিন লাখ ১৮ হাজার ৭৪৯ জন। গত বছর এক হাজার ৭০৫ জন মশাবাহিত এ রোগে মারা গেছেন, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারা দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা যান।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ