ঢাকা, শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

দীর্ঘ হচ্ছে ক্যানসার আক্রান্তের তালিকা

প্রকাশনার সময়: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:১৭

দেশে দীর্ঘ হচ্ছে ক্যানসার রোগীর তালিকা। অধিকাংশ রোগী শনাক্তের বাইরে। এরপরও যেসব রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে তাদের মধ্যে পুরুষের ফুসফুস ও নারীর স্তন ক্যানসারে আক্রান্তের হার বেশি।

ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রতি বছর মারা যান প্রায় ৯১ হাজার। মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিরা প্রধানত ফুসফুস, কোলোরেক্টাল, পাকস্থলী, লিভার, স্তন, খাদ্যনালী, প্যানক্রিয়াস ও জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে শনাক্ত মোট ক্যান্সার রোগীর প্রায় ১৬ শতাংশই ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত। অনেক ক্ষেত্রে ক্যান্সার শুধু ফুসফুসেই সীমাবদ্ধ না থেকে তা লসিকাগ্রন্থি ও অন্যান্য অঙ্গে (যেমন মস্তিষ্ক, হাড় ইত্যাদি) ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে আসা প্রায় ৩৬ হাজার রোগীর ডায়াগনোসিস করে পুরুষের ফুসফুস ও নারীদের স্তন ক্যানসারে আক্রান্তের হার বৃদ্ধির এই চিত্র পাওয়া গেছে। একই সময়ে ৮৩ হাজার ৭৯৫ জন নতুন রোগী এলেও এদের মধ্যে ৩৫ হাজার ৭৩৩ জনের ডায়াগনোসিস হয়েছে। এতে ক্যানসার শনাক্ত হয় ৪২ দশমিক ৬ শতাংশের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জাতীয়ভাবে ২০১৩ সালে একবার জনসংখ্যাভিত্তিক গবেষণা করেছিল। তারপরে আর হয়নি। আমরা নতুন করে অনুরোধ জানিয়েছি। এটা প্রয়োজন। কিন্তু এর জন্য আমাদের দেশ কতটা প্রস্তুত তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, গবেষণা মানে একজন রোগীর ডায়াগনোসিস থেকে শুরু করে সার্বিক অবস্থা কোন পর্যায়ে, কোথায় গিয়ে থামতে পারে তা লিপিবদ্ধ করা। যা বেশ কঠিন। কেননা, আমাদের ডায়াগনসিস ও সুযোগ-সুবিধার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. শামিউল ইসলাম বলেন, খাদ্যাভ্যাস ও পরিবেশও ক্যানসারের একটি কারণ। এ নিয়ে কয়েক বছর আগেও আমাদের কাজ করা সহজ ছিল না। চিকিৎসা ব্যবস্থাও খুব বেশি উন্নত ছিল না। এখন পরিবর্তন হয়েছে। তবুও অনেক ঘাটতি রয়েছে। অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ইনস্টিটিউট প্রয়োজন। দেশে নতুন করে আটটি মেডিকেল কলেজ হচ্ছে। হয়তো সেখানে হবে। আর যারা কাজ করবে তাদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয় বেশি। এ কারণে এই জায়গায় গুরুত্ব দিতে হবে রাষ্ট্রের। যেখানে মেডিকেল সাইন্স উন্নত হয়েছে, সেখানে আমরা এখনো পিছিয়ে। ডায়াগনোসিস করতে পারছি না। কেন এমনটি হবে।

অধ্যাপক ডা. মো. শামিউল ইসলাম বলেন, ধূমপানসহ বিভিন্ন অভ্যাসের জন্য নিজ থেকেই ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার কারণ হচ্ছি কিনা তা চিন্তা করা উচিত। এটি নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি যারা নীতিনির্ধারক রয়েছেন, তাদের গুরুত্ব দিতে হবে বিষয়টি। কোন ক্যানসার প্রতিরোধযোগ্য ও কোনটির চিকিৎসার প্রয়োজন, চিকিৎসা ছাড়া হবে তা নির্ণয় করতে হবে। পৃথক লিঙ্গ ও বয়সকেও গুরুত্ব দিতে হবে।

বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের হার দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশে নারীরা যেসব ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তার মধ্যে স্তন ক্যান্সার শীর্ষে রয়েছে। নারীদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্তন ক্যানসারের আশঙ্কা বেড়ে যায়। আজকাল কমবয়সি মেয়েদের মধ্যেও স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ছে। নারীদের কম বয়সে ঋতুস্রাব শুরু হলে এবং দেরিতে মেনোপজ হলে এতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া দেরিতে সন্তান গ্রহণ, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, চর্বিজাতীয় খাবার বেশি খাওয়া, স্থূলতা, দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন বা হরমোন ইনজেকশন নিলে স্তন ক্যানসার হতে পারে। বংশগত কারণেও স্তন ক্যানসার হতে পারে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএআরসি বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৩ হাজারের বেশি নারী নতুন করে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। মারা যান ৬ হাজার ৭৮৩ জন।

জানা গেছে, নবম শ্রেণির নারীর স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। প্রথমত, বয়স ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে হলে। দ্বিতীয়ত, স্তন ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে। তৃতীয়ত, বেশি বয়সে প্রথম সন্তান ধারণ করা অথবা নিঃসন্তান থাকা। চতুর্থত, সন্তানকে বুকের দুধ পান না করানো। পঞ্চমত, দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য পিল বা বড়ি খাওয়া। ষষ্ঠত, ১২ বছর বয়সের আগে প্রথম ঋতুস্রাব হওয়া অথবা ৫০ বছর পরে ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়া। সপ্তমত, অত্যধিক চর্বিযুক্ত খাদ্যাভ্যাস। অষ্টমত, ধূমপান, মদ্যপান এবং তামাকজাতীয় দ্রব্যে আসক্ত থাকা এবং নবমত, দীর্ঘদিন তেজস্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে থাকা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্রেস্ট, ল্যাপারোস্কোপিক ও কলোরেক্টাল সার্জন এবং সহকারী অধ্যাপক ডা. মোছা. বিলকিস ফাতেমা বলেন, একটু সচেতন থাকলেই এ ব্যাধিকে প্রতিরোধ করা যায়। ঝুঁকিতে থাকা এই ৯ শ্রেণির নারী নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে খুব সহজে এ বিপদ এড়িয়ে চলতে পারেন। ৩৫ বছরের ওপরের নারীরা ম্যারেনাগ্রাফিক স্ক্রিনিং করে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন।

তিনি বলেন, তাছাড়া ক্যানসার কোন পর্যায়ে আছে, তার ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা পদ্ধতি। স্তন ক্যানসার যদি প্রাথমিক অবস্থাতেই শনাক্ত করা যায়, তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে দ্রুত ও সহজে সারিয়ে তোলা সম্ভব। তাই উপসর্গ দেখা দিলে সংকোচ দূর করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। পাশাপাশি নিজে নিজে স্তন পরীক্ষার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

প্রাথমিক পর্যায়ে কাশি, জ্বর, কাশির সঙ্গে রক্ত কিংবা শ্বাসকষ্ট ফুসফুস ক্যানসারের কিছু সাধারণ উপসর্গ, যেগুলো ফুসফুসে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে। অনেক সময় ক্যানসার ফুসফুস থেকে অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়ে; যেমন হাড়ে ছড়িয়ে পড়লে প্রবল ব্যথা অনুভব হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ফুসফুস ক্যানসার মস্তিষ্কেও ছড়িয়ে যেতে পারে। এটি পেটে বা লিভারে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এ ক্ষেত্রে পেটে ব্যথা হতে পারে। অনেক সময় জন্ডিস হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালের অনকোলজি ও রেডিওথেরাপি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের দেশে বিশেষ করে পুরুষরা ফুসফুসে ক্যানসারে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এ ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অ্যাডভান্সড স্টেজে আসে। তখন ক্যানসার পুরোপুরিভাবে নির্মূল করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। ফুসফুসে ক্যানসারের প্রধান কারণ হিসেবে ধূমপানকে চিহ্নিত করা হয়। তাই আমাদের দেশে সাধারণত পুরুষের তুলনায় নারীরা এ রোগে কম আক্রান্ত হয়ে থাকেন। ধূমপান ছাড়াও ধুলোবালু, হাইড্রোকার্বন ইত্যাদি দূষণমূলক উপাদানের কারণে আমাদের দেশের মানুষ ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকে।’

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ