ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬
১০ই নভেম্বর থেকে তিন দিনব্যাপী

দুই শতকের সম্প্রীতির নজির, কার্তিকে কলসকাঠীতে জগদ্ধাত্রী পূজা

প্রকাশনার সময়: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১৮:১০ | আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১৮:১৭
ছবি: মলয় মিত্র

উৎসব বঙ্গ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সারা বাংলা যখন শারদীয়া ও দীপাবলির শেষের মন খারাপ ভুলতে থাকেন পরের বারের কথা ভেবে। তখনই পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর, চন্দননগর সহ পারিপার্শ্বিক অঞ্চলের মানুষ মেতে ওঠেন মা জগদ্ধাত্রীর আরাধনায়। জগদ্ধাত্রী, যিনি জগতকে ধারণ করেন। উপনিষদে তার নাম উমা হৈমবতী। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, মায়ের পূজা মহাধূমধামে পালিত হয় বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের বৃহত্তম জগদ্ধাত্রী পূজো অনুষ্ঠিত হয় কলসকাঠীতে। আগামী ১০ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে ৩ দিনব্যাপী জগদ্ধাত্রী পূজা।

কলসকাঠী বাংলাদেশের বরিশাল জেলার অন্তর্গত বাকেরগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। কলসকাঠীতে অবস্থিত একটি প্রাচীন জমিদার বাড়ি, যেটিকে শুধু বাড়ি বললে কম বলা হয়, বরং বলা হয় একটি প্রাচীন শহর। জমিদার বাড়ির পাশেই অবস্থিত প্রাচীন শিব মন্দির। যেখানে রয়েছে মূল্যবান কষ্ঠি পাথরের মূর্তি। মন্দিরের সামনে রয়েছে বেদী, যেখানে পশু বলি দেওয়া হয়। প্রতিবছর এই মন্দিরেই মহাসমারোহে মা জগদ্ধাত্রীর আরাধনা করা হয়। তিন দিন ধরে চলে মায়ের পূজা।

জগদ্ধাত্রী পূজাকে কেন্দ্র করে কলসকাঠী রূপ নেয় এক মিলনমেলায়। দেশের দূর দূরান্ত থেকে লক্ষাধিক মানুষ ছুটে আসে প্রাচীন এই জগদ্ধাত্রী পূজাতে। জগদ্ধাত্রী পূজায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, আনসার, গ্রাম পুলিশসহ সকল আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সর্বদা নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকে।” পুজো উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা দোকান দেন কলসকাঠীতে। এছাড়াও পুজোয় বিনোদনের জন্য কলসকাঠীতে থাকে রাধা চক্কর, গানের আসর, ব্যান্ড শো সহ নানান অনুষ্ঠান। জগদ্ধাত্রী পুজো উদযাপন কমিটির উপদেষ্টাদের মতে, “প্রতি বছর কলসকাঠিতে মোট ৭টি মন্ডপে জগদ্ধাত্রী পুজো উদযাপিত হবে। কালীবাড়ি পুজো মন্ডপ ও সৎ সঙ্গ পুজো মন্ডপে প্রতিযোগিতামূলকভাবে এ পুজো উদযাপিত হয়ে থাকে।”

আরো পড়ুন: তের জমিদারের প্রাচীন শহর কলসকাঠী

জগদ্ধাত্রী পূজা উপলক্ষে প্রতিটি মন্দিরে নির্মাণ করা হয় সুদৃশ্য তোরন। সাজসজ্জায় যেন কোনো মন্দির পিছিয়ে নেই। কলসকাঠী কালীবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে, জনতা ব্যাংকের গলিতে, কর্মকারপাড়া এবং বাজারের রাস্তায় রাস্তায় দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন দোকানে খেলনাসহ পসরা সাজিয়ে বসেন। প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও কলসকাঠীতে মোট নয়টি মন্দিরে অর্থাৎ ৩টি মন্দিরে সার্বজনীন ও ৬টি মন্দিরে পারিবারিকভাবে এ পূজা উদযাপিত হবে। প্রতিমা তৈরি, সাজসজ্জা ও লাইটিং প্রতিযোগিতায় দুটো মন্দির শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে একটি কালীবাড়ি পূজা মন্দির আরেকটি সৎসংঘ পূজা মন্দির।

জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন কীভাবে শুরু হয়?

জগদ্ধাত্রী পূজার কথা বলতে গেলে প্রথমেই নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর ও হুগলি জেলার চন্দননগরের কথা শোনা যায়। এই জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন হবার পেছনে কিছু ইতিহাস আছে। জগদ্ধাত্রী পূজা বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি বিশিষ্ট উৎসব হলেও, দুর্গা বা কালীপূজার তুলনায় এই পূজার প্রচলন অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে ঘটে। অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তার রাজধানী কৃষ্ণনগরে এই পূজার প্রচলন করার পর এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। যদিও দেবী জগদ্ধাত্রী যে বাঙালি সমাজে একান্ত অপরিচিত ছিলেন না, তার প্রমাণও পাওয়া যায়। শূলপাণি খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতকে কালবিবেক গ্রন্থে কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পূজার উল্লেখ করেন। পূর্ববঙ্গের বরিশালে খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তরমূর্তি পাওয়া যায়। বর্তমানে এই মূর্তিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্নবিভাগে রক্ষিত। কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে নির্মিত নদীয়ার শান্তিপুরের জলেশ্বর শিবমন্দির ও কোতোয়ালি থানার রাঘবেশ্বর শিবমন্দিরের ভাস্কর্যে জগদ্ধাত্রীর মূর্তি লক্ষিত হয়। তবে বাংলার জনসমাজে কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বে জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। কেবল কিছু ব্রাহ্মণগৃহে দুর্গাপূজার পাশাপাশি জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হতো।

জগদ্ধাত্রী পূজা ঠিক কবে চালু হয়, তা নিয়ে অনেক মত আছে। যদিও কৃষ্ণনগরেই এই পূজা প্রথমে চালু করেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়। কিংবদন্তি অনুসারে নবাব আলিবর্দি খাঁ, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় এর নিকট থেকে বারো লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করেন। নজরানা দিতে অপারগ হলে তিনি রাজাকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান। তিনি মীরকাশিমের হাতে বন্দি হয়েছিলেন। দুর্গাপূজার ঠিক আগে কিছু খাজনা মিটিয়ে মুক্তি পেয়ে নদীপথে নৌকায় কৃষ্ণনগরে প্রত্যাবর্তনের সময় ঘাটে বিজয়া দশমীর বিসর্জনের বাজনা শুনে তিনি বুঝতে পারেন সেই বছর ১৭৬১ দুর্গাপূজার কাল উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। জনশ্রুতি সেখানেই কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নে দেখেছিলেন যে এক রক্তবর্ণা চতুর্ভুজা কুমারী দেবী তাকে বলছেন আগামী কার্তিক মাসের শুক্লানবমী তিথিতে তার পূজা করতে। সেই বছর আর দুর্গাপূজা করা সম্ভব হয়নি। দুর্গাপূজার আয়োজন করতে না পেরে রাজা অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লে দেবী দূর্গা সেই রাতেই স্বপ্নে দুর্গা জগদ্ধাত্রীর রূপে রাজাকে পরবর্তী শুক্লানবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী দুর্গার পূজা করার আদেশ দেন। দুর্গাপূজার ক্ষণ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে কৃষ্ণচন্দ্র সিদ্ধান্ত নেন রামচন্দ্রের অকালবোধনের মতো তিনিও অসময়ে দুর্গাপূজা করবেন জগদ্ধাত্রী পূজার ভেতর দিয়ে। পণ্ডিতেরা বলেছিলেন, জগদ্ধাত্রী ও দুর্গা অভিন্ন। সেই থেকেই এই পূজার সুত্রপাত। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা ১৭৬২ সালে। কেউ কেউ আবার কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশচন্দ্রকে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তক মনে করেন। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দরজা জগদ্ধাত্রী পূজার সময় আজও খোলা থাকে। পূজা পুরনো প্রথা মেনে হয় শুধুমাত্র নবমী তিথিতে।

১৭৭২ সালে রাজবাড়ির দেখাদেখি কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রজারা জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেন। বুড়িমার পূজা নামে পরিচিত এই পূজা শুরু হয়েছিল ঘটে ও পটে। প্রথম দিকে স্থানীয় গোয়ালারা দুধ বিক্রি করে এই পূজার আয়োজন করতেন। ১৭৯০ সাল নাগাদ গোবিন্দ ঘোষ ঘটপটের পরিবর্তে প্রতিমায় জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল প্রায় সাড়ে সাতশো ভরি সোনার গয়নায় দেবীপ্রতিমার অলংকারসজ্জা। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দাদের মতে এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা, তার নিকট সকল মনষ্কামনাই পূর্ণ হয়।

চন্দননগরের দক্ষিণে গৌরহাটি গ্রামে সম্ভবত ১৭৬২ সনে কৃষ্ণচন্দ্রের এক দেওয়ান দাতারাম সুর ফেরিঘাট অঞ্চলে তার বিধবা কন্যার বাড়িতে প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেন কৃষ্ণচন্দ্রের অনুদানে। কৃষ্ণচন্দ্রের পদস্থ কর্মচারীরা রাজার উৎসাহে জগদ্ধাত্রী পূজা নানা জায়গায় চালু করেন। এগুলি ছিল পারিবারিক পূজা , পরে ব্যবসায়ী শ্রেণির হাতে এই পূজা চলে যায়। আরো পরে ব্যবসায়ী শ্রেণির পাশাপাশি এই পূজা বারোয়ারি পূজা হিসাবে প্রচলিত হতে থাকে। পূজার কাজে সাধারণ মানুষও অংশ নিতে থাকে।

কিন্তু চন্দননগরে কে এই পূজা প্রচলন করেন এই প্রশ্নে অনেক মতভেদ আছে। অনেকেই বলেন, ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, অথচ ইন্দ্রনারায়ণ মারা গেছেন ১৭৫৬ সনে আর জগদ্ধাত্রী পূজা কৃষ্ণনগরে চালু হয় ১৭৬২ সনে। কাজেই কৃষ্ণনগর থেকে চন্দননগরে ইন্দ্রনারায়ণ জগদ্ধাত্রী পূজাকে আনেননি। তাহলে কে? এ তো গেল ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা! অন্য আর এক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ ইন্দ্রনারায়ণ (ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, যা সঠিক নয় সম্ভবত দাতারাম সুর) ছিলেন চন্দননগরের ফরাসি সরকারের দেওয়ান।

লক্ষ্মীগঞ্জ কাপড়পট্টির জগদ্ধাত্রী পূজা চন্দননগরে দ্বিতীয় প্রাচীনতম পূজা। ১৭৬৮ সালে চালপট্টির চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় কাপড় ব্যবসায়ী শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায় (মতান্তরে শশধর) রীতিমতো চাঁদা তুলে এই পূজা প্রবর্তন করেন। বর্তমানে সারা রাজ্যেই, বাংলাদেশের কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে জগদ্ধাত্রী পূজা হয়ে থাকে যদি কৃষ্ণনগরের বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পূজা হয় দুশোরও বেশি যা জগদ্ধাত্রী পূজার জন্য বিখ্যাত চন্দননগরের চেয়েও অনেক বেশি।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ