মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতের জেরে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। সীমান্তের নানা পয়েন্টে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নানা সতর্কতার পরও অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরবর্তী পরিস্থিতিতে এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সুযোগ নিচ্ছে সংঘবদ্ধ দালাল চক্র।
সীমান্তের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সরকার পতনের পরপর কয়েকদিন সীমান্ত এলাকাসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন তৎপরতা ছিল না। মূলত এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দালালরা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তা শুরু করে। সম্প্রতি তৎপরতা বাড়ানো হলেও সংঘবদ্ধ দালালরা রাতের আঁধারে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তা করছে।
গত ৫ আগস্টের পর নানাভাবে ১০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ ও জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, গত রোববার পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ হাজার রোহিঙ্গা নানাভাবে অনুপ্রবেশ করেছে।
সরকারি একটি দায়িত্বশীল সংস্থার তথ্য বলছে, রবিবার মধ্যরাত থেকে গত সোমবার ভোর পর্যন্ত টেকনাফ ও উখিয়ার ৩০টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অন্তত ৪৭৫ জন রোহিঙ্গার নতুন করে অনুপ্রবেশের তথ্য পেয়েছেন। সেই সব রোহিঙ্গা নানাভাবে ক্যাম্পে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ির পাশাপাশি অনেকে ভাড়াবাসায় অবস্থান নিয়েছে বলে জানা গেছে।
বিষয়টি একপ্রকার স্বীকার করেছেন উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. গফুর উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, রাতে টেকনাফের নাফ নদ সীমান্ত দিয়ে নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে প্রবেশ করতে দেখেছেন। এসব রোহিঙ্গা যাতে স্থানীয়দের বাসাবাড়িতে অবস্থান নিতে না পারে, তার জন্য এলাকাবাসীকে সতর্ক করা হয়েছে। সীমান্ত সুরক্ষায় আরো কঠোর নজরদারির দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যথায় আবারো ২০১৭ সালের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামতে পারে। এ বিষয়ে বিজিবির কক্সবাজার ও টেকনাফের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপের জন্য একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা ধরেননি। খুদেবার্তা পাঠিয়েও মেলেনি সাড়া।
তবে বিজিবির সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানিয়েছেন, সীমান্তে বিজিবির পক্ষে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছে। গত এক মাসে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী ৪ হাজার ৫০৬ জন রোহিঙ্গাকে আটকের পর ফেরত পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে বিজিবির অভিযানে ইয়াবাসহ বিভিন্ন প্রকার মাদক পাচার ও অন্যান্য চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৪৩ জনকে এবং অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের দায়ে ১২৫ বাংলাদেশি নাগরিক ও ২২ ভারতীয় নাগরিককে আটকের পর তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশনের ইনচার্জকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। টেকনাফে কোস্টগার্ড ছাড়াও নৌপুলিশের একটি ফাঁড়ি রয়েছে। তারা জানিয়েছে, নৌপুলিশের ফাঁড়িতে বর্তমান কোনো কর্মকর্তা নেই। চারজন স্টেশনে রয়েছেন। তাদের কোনো ধরনের জলযান নেই। কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে দেখা গেলেও বাঁশি বাজানো ছাড়া তাদের আর করার কিছু ছিল না। সরকারের প্রশাসনিক শীর্ষ এক কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য রয়েছে। দালালরা কৌশলে এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তা করছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্তের যে পরিস্থিতি, তাতে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে জনবল তা দিয়ে নিশ্ছিদ্র নজরদারি সম্ভব হচ্ছে না। এ সুযোগে দালাল চক্রের মাধ্যমে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য নানা মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে। এসব রোহিঙ্গার অনেকেই ক্যাম্পে অবস্থানকারী স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিচ্ছে। আবার কেউ কেউ স্থানীয়দের ভাড়াবাসায় অবস্থান নেয়ার তথ্যও মিলেছে। তবে কত রোহিঙ্গা সাম্প্রতিক সময়ে অনুপ্রবেশ করেছে তার কোনো সঠিক তথ্য জানা যাচ্ছে না।
তবে সীমান্তের বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তথ্য বলছে, আগস্ট মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। টেকনাফের জাদিমোরা, দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ, আলীর ডেইল, মহেশখালীয়া পাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া ও বাহারছড়া উপকূল এবং উখিয়ার বালুখালী, ঘুমধুম সীমান্তসহ অন্তত ৩০টি পয়েন্টে দিয়ে এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। মিয়ানমারের মংডুর উত্তরের প্যারাংপুরু ও দক্ষিণের ফাদংচা এলাকায় জড়ো থাকা রোহিঙ্গারা দালালদের সহায়তায় এই অনুপ্রবেশ অব্যাহত রেখেছে। শতাধিক দালাল এই কাজে জড়িত।
এদিকে নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তাদের তালিকা করারো উদ্যোগ দেখা যায়নি এখন। যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত এলেও তাদের খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছে সীমান্তের মানুষ।
এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেছেন, মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্তের জন্য তারা তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এখনো নতুন রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি তাদের কাছে। ফলে নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাদের কোনো উদ্যোগ নেই। তিনি বলেন, নতুন করে যারা অনুপ্রবেশ করেছে, তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আত্মীয়-স্বজনের কাছে রয়েছে। যারা যুদ্ধে আহত হয়েছে, তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। ওপর থেকে নির্দেশনা এলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। মিজানুর রহমান বলেন, আমরা খবর পেয়েছি বাংলাদেশের কিছু দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা দেশে ঢুকছে। বিষয়টি নিয়ে বিজিবিসহ সবাইকে জানানো হয়েছে আরো কঠোর হওয়ার জন্য।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ