ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

প্রত্যন্ত গ্রামে গড়ে ওঠা অদম্য এক নারী ফুটবলার

প্রকাশনার সময়: ০৮ মার্চ ২০২৪, ১২:০২
বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের স্ট্রাইকার কৃষ্ণা রানী সরকার। ছবি- নয়াশতাব্দী

ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করতেন কৃষ্ণা রানী সরকার। সারাক্ষণ ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। দিনের বেশিরভাগ সময় খেলা নিয়ে বাড়ির বাইরে থাকতেন বলে প্রায়ই বকা দিতেন মা। লেখাপড়ায় অমনোযোগী কৃষ্ণা ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল নিয়ে মাতামাতি করায়, লোকে নানারকম কটাক্ষও করতেন। অতিষ্ঠ হয়ে বল কেড়ে নিয়ে কেটে ফেলতেন তার মা। একাধিকবার বন্ধ করে দিয়েছেন খেলা। তবুও দমাতে পারেননি কৃষ্ণার ফুটবলপ্রেম।

খেলতে না দেওয়ায় খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে অনশন করেন কৃষ্ণা। পরে বাধ্য হয়ে খেলার সুযোগ দিয়েছেন বাবা-মা। যার ফলে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা উত্তর পাথালিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা এই ফুটবলার বনে যান বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের স্ট্রাইকার।

যদিও ২০২৩ সালে ইনজুরিতে পড়ার পর এখন পর্যন্ত তিনি জাতীয় দলের খেলা থেকে বিরত রয়েছেন। তবে নিয়মিত প্রাকটিস করছেন কৃষ্ণা। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গড়ে ওঠা কৃষ্ণা রানী সরকার এখন সারাদেশের তরুণ নারী ফুটবলারের আইকন হয়ে উঠেছেন।

কৃষ্ণার বাবা এখনো কৃষি কাজ করেন। আর মা গৃহিনী। বাবা বাসুদেব সরকার ও মা নমিতা রানী সরকারের দুই সন্তানের মধ্যে কৃষ্ণা বড়। তার জন্ম ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি। ফুটবল পায়ে প্রথমে নজরে আসেন ২০১০ সালে উপজেলা পর্যায়ে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আন্তঃপ্রাথমিক ফুটবল টুর্নামেন্টে। সে সময় কৃষ্ণার নেতৃত্বে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উত্তর পাথালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। ওই টুর্নামেন্টে কৃষ্ণা সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ায় সূতি ভিএম পাইলট মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শরীরচর্চা শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপনের নজরে পড়েন এই ফুটবল কন্যা।

তার অসাধারণ ক্রীড়া নৈপূণ্য দেখে শরীরচর্চা শিক্ষক বাপন আগ্রহ নিয়ে কৃষ্ণার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর কৃষ্ণাকে তার স্কুলে বিনা বেতনে ভর্তি করান। সেখান থেকেই ফুটবল চর্চার অবাধ সুযোগ পান কৃষ্ণা।

কৃষ্ণার ফুটবল নৈপূণ্য আর বিশেষ ভূমিকায় জাতীয় স্কুল ও মাদরাসা ফুটবল প্রতিযোগিতায় ২০১১, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে টানা তিনবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। পরবর্তীতে জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা ফুটবল দল গঠন করা হলে, কৃষ্ণাসহ একই স্কুল থেকে আরও দুই কিশোরী ফুটবলার বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা ফুটবল দলেও জায়গা করে নেন।

২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক ফুটবলে কৃষ্ণার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। পরের বছরেও শিরোপা ঘরে তোলে বাংলাদেশ। তবে সেই দলে বয়সের কারণে ছিলেন না কৃষ্ণা। তবে একই বছর ঢাকায় হওয়া এএফসসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের বাছাইয়ে গ্রুপ পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হয় বাংলাদেশের মেয়েরা। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন কৃষ্ণা রানী সরকার। একইসঙ্গে সেই আসরে ৮ গোল করে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন বিস্ময়কর এই ফুটবলকন্যা।

২০১৭ সালে কৃষ্ণার নেতৃত্বেই থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের মূল পর্বে খেলার গৌরব অর্জন করেছে লাল-সবুজের দল। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ভারতে হওয়া সাফ ফুটবলে রানার্সআপ হয় বাংলাদেশ। যে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন কৃষ্ণা।

২০২২ সালে নেপালের সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ। দেশের হয়ে তিন গোলের মধ্যে দুটোই করেন কৃষ্ণা রানী সরকার।

কৃষ্ণার মা নমিতা রানী সরকার বলেন, এক সময় টাকার অভাব ও গ্রামের মানুষের কটূকথার কারণে মেয়েকে ফুটবল খেলতে বারণ করেছিলাম। তারপরও কৃষ্ণার ইচ্ছার কাছে কটূক্তি করা মানুষজন হেরে গেছে। সে এখন দেশের গৌরব।

এ বিষয়ে কৃষ্ণা রানী সরকার নয়া শতাব্দীকে বলেন, নারীদের আলাদা কোনো দিবস নেই। প্রতিদিনই নারীদের দিবস। প্রথম অবস্থায় পরিবার থেকে কোনো সাপোর্ট পাইনি। পরিবারর কাছ থেকে বকাঝকাও খেতে হয়েছে। পাশাপাশি এলাকার মানুষের কাছ থেকে কটাক্ষও শুনতে হয়েছে। তবে আমি নিয়মিত ফুটবল খেলা চালিয়ে গিয়েছি।

বর্তমানে নিজেই পরিবারের যাবতীয় খরচ বহন করছেন জানিয়ে এই ফুটবলকন্যা বলেন, পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় নিজের খরচ নিজেকেই বহন করতে হয়েছে। এখন আমি পরিবারের যাবতীয় খরচ বহন করছি। যদিও ২০২৩ সালে খেলার সময় আমি ইনজুরিতে পড়ি। তখন থেকে আর জাতীয় দলের খেলা হয়নি। তবে নিয়মিত ক্যাম্পে প্রাকটিস চালিয়ে যাচ্ছি।

নয়াশতাব্দী/এনএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ