ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫
১০০ ব্যাগ সিমেন্ট আর ২ টন রডের গল্প

ঘুষ না পেয়ে ডিবি কর্মকর্তার অদ্ভুত তদন্ত প্রতিবেদন!

প্রকাশনার সময়: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:৩৮
অভিযুক্ত তদন্ত কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন। ছবি- শাহীন মাহমুদ রাসেল

চাহিদা মতো ঘুষ না দেওয়ায় চাঁদাবাজি কেন্দ্রীক আদালতে গায়েবি ও হাস্যকর প্রতিবেদন দাখিলের অভিযোগ উঠেছে গিয়াস উদ্দিন নামে এক তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে করা মামলায় ১০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে একটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে ‘তিন সংবাদকর্মীসহ চার যুবক ১০০ ব্যাগ সিমেন্ট ও দুই টন রড নিয়ে গেছে’ উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে রীতিমত হাস্যরসের জন্ম দিয়েছেন তিনি।

অভিযুক্ত তদন্ত কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন কক্সবাজার গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত।

তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেন ‘দৈনিক খোলা কাগজ’ পত্রিকার উখিয়া প্রতিনিধি মুসলিম উদ্দিন।

তার অভিযোগ, ভূমি কেন্দ্রীক একটি চাঁদাবাজি মামলার বিষয়ে ডিবি কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন তার কাছ থেকে এক লাখ টাকা অফিস খরচ দাবি করেন। ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করার পর, বাকি টাকা না পেয়ে ‘রড-সিমেন্ট নিয়ে গেছে’ বলে মনগড়া প্রতিবেদন দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে প্রতিকার পেতে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইজিপি ও ডিআইজিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগে তিনি দাবি করেন, দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার, রাষ্ট্রদ্রোহী, হত্যা, সন্ত্রাসী, নাশকতা, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাসহ দেশজুড়ে অগণিত মামলায় অভিযুক্ত আসামি বশির আহমদ ওরফে বশির মাহমুদ, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে, গত ২৯ ডিসেম্বর চারজনের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে কক্সবাজার আদালতে একটি মিথ্যা ও সাজানো মামালা দায়ের করেন।

আদালত ওই মামলা কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে তদন্তের দায়িত্ব দিলে দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বাদী বশিরের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাদের নামে মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট, বিতর্কিত একটি গায়েবি রিপোর্ট আদালতে দাখিল করে আদালত পাড়ায় হস্যরসের জন্ম দিয়েছেন।

অভিযোগ আরও উল্লেখ করা হয়েছে, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে উখিয়ার রাষ্ট্রদ্রোহী, হত্যা, সন্ত্রাসী, নাশকতা, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাসহ অগণিত মামলার আসামি দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার বশির আহমদ ওরফে বশির মাহমুদের দায়ের করা মিথ্যা ও সাজানো চাঁদাবাজি মামলা দাখিলের ক্ষেত্রে বিতর্কিত ভূমিকা রাখেন তদন্ত কর্মকর্তা।

এমনকি আসামিদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে অনৈতিক প্রস্তাব দেন বলেও অভিযোগে দাবি করা হয়।

ভুক্তভোগীদের পক্ষে সাংবাদকর্মী মুসলিম উদ্দিন জানান, আমি জাতীয় দৈনিক ‘খোলা কাগজ’ পত্রিকার একজন নিয়মিত সাংবাদিক। সংশ্লিষ্ট মামলায় অভিযুক্ত অপরাপর আসামিরাও স্থানীয় সংবাদকর্মী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন। অন্যদিকে অভিযোগকারী মামলার বাদী একজন ধূর্ত প্রকৃতির কুখ্যাত শিবির ক্যাডার ও রাষ্ট্র বিরোধী। তার কথিত মামলায় মানিত সাক্ষীরা সবাই আমার বোনকে হত্যা চেষ্টা মামলার আসামি। এসব তথ্য জানা থাকার পরও তদন্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন আমাদের তার কার্যালয়ে ডেকে নেন। অফিস খরচের কথা বলে টাকার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখে সেখানে নানা ধরণের বেআইনী প্রস্তাব দেন। তিনি তদন্ত প্রতিবেদন আসামিদের পক্ষে দেবেন মর্মে এক লক্ষ টাকা দাবি করেন। ওই সময় তিনি বলেন, ‘টাকা না দিলে চাঁদাবাজির প্রতিবেদন দাখিল করলে মামলায় আট বছর থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন চাঁদাবাজি মামলায় পাঁচ বছর সাজা হবে। কি করবেন দেখেন, অন্যথায় এক মাসের মধ্যে জেলের ভাত খাওয়াবে’ বলেও হুমকি দেন তিনি।

‘এছাড়াও মামলার খরচ আছে দাবি করলে, আমার বন্ধু সাইফুলের মাধ্যমে ধার করে টাকা এনে খামে ভরে ৩০ হাজার টাকা দিই। এরপরে আরও ৫০ হাজার টাকা দাবি করলে আমি অপারগতা প্রকাশ করি। তার পরেও আমি সেখানে সাফ জানিয়ে দিই- ঘুষ হিসেবে কোনো টাকা দিতে পারবো না। অভিযোগের বিষয়ে যা সত্য তাই প্রতিবেদন দেবেন। এটাই আপনার পেশাদারিত্ব।’

কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন উক্ত প্রতিবেদনে আমাদের পূর্বের মামলার আসামিদের ‘নিরপেক্ষ সাক্ষী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রতিবেদনটিতে বাদীর আর্জির পূণরাবৃত্তি করেছেন। বাদী তার আর্জিতে অভিযোগ করেছে, আমরা নাকি বাদীর কাছে চাঁদা না পেয়ে রাত ১১টায় বাদীর বসতঘর থেকে দুই টন রড আর ১০০ ব্যাগ সিমেন্ট নিয়ে এসেছি। যা হাস্যকর কথা।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের নিরপেক্ষ সাক্ষী বানানো হয়েছে তারা মামলার অভিযুক্ত মুসলিম উদ্দিনের দায়ের করা জিআর-৪৮৩/১৯ইং ও তার বাবা বাদী হয়ে দায়ের করা জিআর-৩৮৯/১৯ইং মামলার আসামি, যা আইন সঙ্গত নয়।

এছাড়াও উক্ত মামলার বাদীর সঙ্গে পূর্ব বিরোধের কারণে বিভিন্ন সময় ভুক্তভোগী মুসলিম উদ্দিনসহ তার পরিবারকে হত্যা, খুন, গুম, মিথ্যা-বানোয়াট মামলা, হামলার হুমকি দেওয়ার কারণে আমি মুসলিম উদ্দিন বাদী হয়ে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর থানায় সাধারণ ডায়েরিও লিপিবদ্ধ করি। যার নং- ৬৪৪/২৪ইং।

ভুক্তভোগীর এমন অভিযোগের ভিক্তিতে (ভুক্তভোগীর দাবিকৃত মিথ্যা মামলার) বাদীর ফৌঃ দরখাস্ত ও তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বশির আহম্মদ বাদী হয়ে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চাঁদাবাজি ও চুরির অভিযোগ তুলে গত ৩১ ডিসেম্বর মামলাটি দায়ের করেন। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে নির্দেশ দেন। তদন্তের জন্য মামলাটি আদালত থেকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে পৌঁছালে অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গত ৫ জানুয়ারি হাওলা করেন।

ওসি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে মামলা হাওলা করার মাত্র ২৫ দিনের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিনও বাদীর অভিযোগের সাথে মিল রেখে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ‘অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে’ বলে টাকা না পেয়ে বাদীর কাছ থেকে অন্যায় সুবিধা নিয়ে ভিত্তিহীন একটা প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।

মামলায় উল্লেখ করা নির্মাণাধীন ভবনের আশেপাশে বসবাসকারী মোমেনা খাতুন, রাশেদা, মিসবাহ আজাদ, শাকুর মাহমুদ, ছকিনা খাতুনসহ স্থানীয়রা বলেন, এলাকায় চাঁদা দাবি কিংবা চাঁদা না পেয়ে লোহার রড-সিমেন্ট নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। এছাড়াও ১০০ ব্যাগ সিমেন্ট ও ২ টন লোহার রড নিয়ে যেখানে ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিকের বেগ পেতে হয়; সেখানে কেবল ৪ জনই এতো ভারী মালামাল নিয়ে যাওয়ার গল্প পাগল-শিশুও বিশ্বাস করবেনা।

তাদের মতে, তদন্ত কর্মকর্তা রহস্যজনক কারণে অতি উৎসাহী হয়ে একটি সাজানো মামলার অদ্ভুত প্রতিবেদন দিয়ে হাস্যরসের জন্ম দিয়েছেন। এই ধরনের কর্মকর্তাদের কারণে ভবিষ্যতে যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে সাজানো মামলা করতে উদ্বুদ্ধ করবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

রিপোর্টার্স ইউনিটি কক্সবাজারের সভাপতি ও নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, উখিয়ায় সাংবাদিকদের নামে একটি পরিকল্পিত সাজানো মামলায় সিমেন্ট আর লোহার রড নিয়ে যাওয়ার মতো একটি বিষয়ে দুজন তরুণ সংবাদকর্মীকে যেভাবে জড়িয়ে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত রিপোর্ট জমা দিলেন, তা হাস্যকর লাগলো। ঘটনাস্থলের আশপাশের কেউ দেখল না, জানল না সাংবাদিকদের সিমেন্ট আর লোহার রড মাথায় করে নিয়ে যেতে! কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা সেটি দেখেছেন এবং নিজের মতো করে রিপোর্ট দিলেন, যা দুঃখজনক বিষয়। মনে হচ্ছে, ওই তদন্ত কর্মকর্তা সাংবাদিকদের ওপর পূর্বের কোনো ক্ষোভ থেকে, নয়তো প্রতিপক্ষ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্রতিহিংসাবশত রিপোর্ট দিয়েছেন। বিষয়টি আমি আরো অধিকতর তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।

তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে অ্যাডভোকেট সাইফুদ্দিন খালেদ বলেন, এখন ডিজিটাল যুগ। মামলায় অভিযুক্তরা ঘটনাস্থলে ছিলো কিনা, সহজে লোকেশনে শনাক্ত করা যায়। লোকেশনে সংশ্লিষ্টের উপস্থিতি আদৌ আছে কিনা, নিশ্চিত হওয়া তদন্ত অফিসারের দরকার। এছাড়াও ১০০ ব্যাগ সিমেন্ট আর ২ টন রড ৪ জন কিভাবে নিয়ে যায়? সেটিও হাস্যকর। মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে হয়রানি করলে তদন্ত অফিসারকে আদালতে জবাবদিহিতা করতে হবে।

তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে তদন্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, তিনি তদন্তে যা পেয়েছেন, তাই আদালতে জমা দিয়েছেন।

নয়া শতাব্দী/এনএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ