ঢাকা, বুধবার, ৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, ৫ রবিউস সানি ১৪৪৬

ফেনী নদী ও ভূ-রাজনীতি, বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা

প্রকাশনার সময়: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৪১

ফেনী নদী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি শ্রেণি থেকে উৎপন্ন হয়ে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমানার পাশ দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে। তারপর পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে, চট্টগ্রাম থেকে ত্রিপুরাকে পৃথক করে আলীগঞ্জ পর্যন্ত এবং তারপর বঙ্গোপসাগরে পড়ার আগে নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামকে বিভক্ত করে সমতল ভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার বেলছড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রামগড় (খাগড়াছড়ি), ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম) হয়ে প্রবাহিত হয়ে এবং চট্টগ্রাম (মিরসরাই উপজেলা) ও ফেনী (ছাগলনাইয়া, ফেনী, সোনাগাজী উপজেলা) জেলার সীমানা বরাবর প্রবাহিত হয়ে ১০৮ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর সোনাগাজীর কাছে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। রামগড় পর্যন্ত এ নদী দিয়ে ৮০.৫ কি.মি. ছোট নৌকায় সারা বছরই চলাচল করা যায়। বর্ষার বৃষ্টির সময় এটি জলে পূর্ণ থাকে, কিন্তু জলাভূমি এলাকায় ভারি বর্ষণের ফলে দ্রুত স্রোতে এ এলাকা প্লাবিত হয়। পাহাড়ের ঢাল থেকে বেপরোয়া কাঠ গাছ কাটার ফলে নদীটি ক্রমশ পলিতে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে পাহাড়ে ব্যাপক ভাঙন ঘটছে।

ফেনী জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ফেনী নদী বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর দুর্বলতা। এ নদীটি বাংলাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসেবে কাজ করে। ফেনীতে তলিয়ে যাওয়া সাম্প্রতিক বন্যা এ করিডোরের ভঙ্গুরতা এবং জাতীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাব তুলে ধরেছে। কারণ ফেনী নদী উত্তরে কুমিল্লা এবং দক্ষিণে চট্টগ্রামের সঙ্গে সীমানা ভাগ করে, উভয় অঞ্চলের পরিবহন এবং অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সড়ক ও রেলপথের জন্য এটি একটি অনিবার্য ট্রানজিট পয়েন্ট; যা বাংলাদেশের বৃহত্তম বন্দর শহর এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্র চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার সংযোগ স্থাপন করে। তিনটি উল্লেখযোগ্য নদী— মুহুরী, ফেনী এবং সিলোনিয়া; ফেনীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, যা জেলার কৌশলগত গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। এ নদীগুলো শুধুমাত্র স্থানীয় কৃষিকেই লাভবান করে না বরং ভারতের সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আন্তঃসীমান্ত নদী ফেনীতে দ্বিতীয় এমওইউতে সমঝোতা স্মারকে, বাংলাদেশ ফেনী নদী থেকে ভারতের ১.৮২ কিউসেক (ঘনফুট প্রতি সেকেন্ড) পানি প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছিল, যা পানি সংকটের মধ্যে থাকা সাব্রুম শহরের পানি সরবরাহের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম, বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে, তবে এটি কার্যত একটি স্থলবেষ্টিত অঞ্চল। ফেনী নদীর পানি ব্যবহার করে ভারতীয় সেচ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের উত্তর ফটিকছড়ি, শুভপুর, সোনাগাজী ও মিরসরাই মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এর ফলে বাংলাদেশকে তার বৃহত্তম মুহুরী সেচ প্রকল্প পরিত্যাগ করতে হবে এবং পুরো এলাকার পরিবেশ সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাবে। ভারত বাংলাদেশের রামগড়ের সঙ্গে সাব্রুম (ত্রিপুরার) সংযোগের জন্য, ফেনী নদীর ওপর একটি ১৫০ মিটার দীর্ঘ চার লেনের সেতু ৭২ কোটি রুপি আনুমানিক ব্যয়ে নির্মাণ করেছে। যাতে স্থলবেষ্টিত সীমান্ত শহরটি বাংলাদেশের রামগড়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এ সেতুটি বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত বাংলাদেশের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে সরাসরি প্রবেশের পথ খুলে দিয়েছে। সাব্রুম থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার, যেখানে সাব্রুম থেকে আগরতলার দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার। বর্তমানে ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশ পশ্চিমবঙ্গের একটি সরু করিডোরের মাধ্যমে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে; যা ‘চিকেনের নেক’ নামে পরিচিত। চট্টগ্রাম বন্দরের সরাসরি রাস্তা দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যকে ত্বরান্বিত করেছে।

এদিকে আরাকান আর্মি (এএ) চীন রাজ্যের পালেতওয়া শহরে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করছে। চিন্ডউইন নিউজ এজেন্সির রিপোর্ট অনুসারে, আরাকান আর্মি চীন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে পালেতওয়া অঞ্চলে প্রবেশ না করার জন্য বলেছে। এএ চলতি বছরের শুরুতে চীন রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরটি দখল করার পর নিজস্ব শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। এএ-এর কর্মকাণ্ডের ফলে শত শত পালেতওয়া বাসিন্দা ভারতের মিজোরাম রাজ্যে পালিয়েছে। এএ-এর বিষয়ে মার্কিন সরকার ও পেন্টাগনের আগ্রহ আছে। এএ, শান রাজ্যে জাতিগত থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স, রাখাইন জুড়ে তাদের অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি এএ, ভামো-মিইটকিনা হাইওয়ে বরাবর সামরিক ক্যাম্প দখল করার পর চীনের সঙ্গে একটি প্রধান বাণিজ্য পথের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এ অঞ্চলে রয়েছে চীনের ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ। যা কৌশলগতভাবে এ অঞ্চলে মার্কিন সরকার ও পেন্টাগনের জন্য চিন্তার বিষয়। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের জান্তা ও এএ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই বাংলাদেশের জন্যও চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ২৭১-কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।

বেশ কিছু বছর ধরে, চীনের আধিপত্য খর্ব করার জন্য বাংলাদেশে সামরিক ঘাঁটির জন্য যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া। এদিকে ‘বাংলাদেশ, ভারতের কিছু অংশ যেমন সেভেন সিস্টার ও মিয়ানমারে আরাকান নিয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠনের ষড়যন্ত্র:’ এজেন্ডা নিয়ে, একটি গ্রুপ গোপনে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবং ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা) এর পরেশ বড়ুয়াসহ বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। গত বছর শেখ হাসিনা ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার থেকে অংশ নিয়ে ‘পূর্ব তিমুরের মতো একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র’ গঠনের ষড়যন্ত্র চলছে।

পেন্টাগন বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে একটি মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কাজ করতে চায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে পেন্টাগন প্রেস সেক্রেটারি মেজর জেনারেল প্যাট রাইডার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের একটি প্রতিরক্ষা সম্পর্ক রয়েছে’। অভিযোগ আছে বাংলাদেশে বিমানঘাঁটি স্থাপন করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন কক্সবাজার-টেকনাফ উপদ্বীপের অগ্রভাগের প্রায় ৯ কি.মি. দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব অংশে একটি ছোট দ্বীপ সেন্টমার্টিনের দিকে নজর তাদের। তবে একটি সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জোর দিয়ে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার বিষয়ে কোনো আলোচনায় জড়িত ছিল না বা এটি করার কোনো ইচ্ছাও নেই।

এদিকে বেশ কয়েক বছর ধরে খ্রিস্টান মিশনারি, সেইসঙ্গে পশ্চিমা এনজিওগুলো গোপনে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় যেমন- টেকনাফ, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, মিজোরাম, মেঘালয়, আরাকান প্রদেশে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছে। অভিযোগ আছে এর মাধ্যমে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের খ্রিস্টান ধর্মে রূপান্তরিত করা এবং বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের ভূখণ্ড নিয়ে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের জন্য ভিত্তি প্রস্তুত করা। তারা বাংলাদেশ, ভারত এবং মিয়ানমারের উপজাতীয় জনসংখ্যাকে এই বলে সংযুক্ত করার চেষ্টা করে, ‘চিন-কুকি-মিজো হল মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী এবং আজ তারা সম্পর্কিত কিন্তু স্বতন্ত্র তিব্বত-বর্মন ভাষায় কথা বলে। মিয়ানমারে এক মিলিয়নেরও বেশি চীন বাস করে, এক মিলিয়ন মিজোরামে, অর্ধ মিলিয়ন কুকি বাস করে মণিপুরে এবং কয়েক হাজার কুকি বাস করে বাংলাদেশে’। এদিকে মণিপুরের কুকিরা ইসরায়েলে ফিরে যাওয়ার দাবি জানাচ্ছে। পি.এস. হাওকিপ, যিনি বার্মিজ/মিয়ানমারের বংশোদ্ভূত এবং কেএনএ (কুকি ন্যাশনাল আর্মি) এবং অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, তারা কুকিরা ইসরায়েলের হারিয়ে যাওয়া উপজাতি। তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতে বেনি মেনাশেকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন।

জুলাই ২০২৩ সালে, হিন্দু পোস্ট একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদী এমএনএফ সরকার ভারত, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী মিজো-কুকি-চিন-জোমি উপজাতিদের একীকরণের মাধ্যমে “মাতৃভূমি” আহ্বান করেছে।’ কেএনএফ এ অঞ্চলে একটি পৃথক পূর্ব রাজ্য প্রতিষ্ঠার দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাদের প্রকৃত এজেন্ডা আড়াল করার জন্য, কেএনএফ নেতারা জামাত উল আনসার ফিল হিন্দ আল শারকিয়া (জেএএফএইচএস) নামে একটি ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। জেএএফএইচএস, কেএনএফকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ‘খিলাফত গ্রাম’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে। এ মিশনের জন্য, জেএএফএইচএস তাবলিগি জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে গোপন যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং জামাত উল আনসার ফিল হিন্দ আল শারকিয়ার মধ্যে সংযোগ বা সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণ কৌশলগত। কেএনএফ পাহাড়ি এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দিতে জেএএফএইচএস ব্যবহার করার কারণ হলো- বাংলাদেশ ও ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য তিনটি প্রতিবেশী দেশের ভূখণ্ড ভেঙে খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা সহজ করা। সুতরাং বলা যায়, ফেনী নদী ও এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর হুমকি।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ