ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৭ জিলকদ ১৪৪৫

গ্যাস-পানির সংকটে ভোগান্তি চরমে

প্রকাশনার সময়: ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৪৭

তানজিম আহমেদ। পূর্ব কাজীপাড়ার মাদ্রাসা রোডের পৈতৃক বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন। কিন্তু কয়েক প্রজন্মের স্মৃতিধন্য সেই বাড়িটিই তিনি এখন বিক্রি করে দিয়ে এ এলাকা ছাড়তে চান। এজন্য ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ক্রেতা খুঁজছেন। কেন কয়েক প্রজন্মের স্মৃতিধন্য পৈতৃক বাড়ি বিক্রির উদ্যোগ? আলাপকালে তানজিম জানান, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস-পানির সংকটের কারণে বাধ্য হয়েই বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এভাবে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বছরের বেশির ভাগ সময় আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাস-পানি নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয়। পবিত্র রমজান মাসে সেই সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। দিনের বেলা কোনো রকমে মিটিমিটি করে জ্বললেও বিকাল হতে না হতেই বন্ধ হয়ে যায় গ্যাসের চুলা। পাশাপাশি মাঝে-মধ্যে পানি আসে। এতেও অনেক সময় দুর্গন্ধ থাকে। যার ফলে ইফতার তৈরি করার সময় চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। রাতে গ্যাস এলেও চাপ থাকে খুবই কম। ফলে সাহরির রান্নাবান্নাতেও ভোগান্তি লেগে থাকে। রাজধানীর মুগদা, মান্ডা, মানিকনগর, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, খিলক্ষেত, উত্তরা, মিরপুরসহ রাজধানীর বেশকিছু এলাকায় এ অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবশ্য এসব এলাকার আবাসিক গ্রাহকদের এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

তানজিম বলেন, ‘আমার বাসায় গ্যাস-পানি থাকে নয়। শুধু আমার না, পুরো এলাকায়। ফলে গত মাসে তিনটি ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া চলে গেছেন। বাকিরাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কখন চলে যায় আল্লাহই ভালো জানেন। এ কারণে বাড়ি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

বাড়িটিতে দাদা, দাদার দাদাও ছিলেন জানিয়ে তানজিম বলেন, ‘ইদানীং গ্যাস-পানির সমস্যা এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, সেখানে বসবাস করাটা তাদের পক্ষে দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

এ এলাকার অনেকেই পানির জন্য সাব-মার্সিবল পাম্প বসাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার সেই সাধ্য নেই। ফলে বাধ্য হয়ে বাড়ি বিক্রি করতেই হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’

ওই এলাকার বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি রমজান ও গরমে এ সমস্যা বাড়ে। ফলে প্রতি বছরই ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। এ বছরও ব্যতিক্রম হয়নি। রাজধানীর পূর্ব কাজীপাড়ার মাদ্রাসা রোডের ৬ ও ৯ নম্বর গলি এলাকার বাড়িগুলোতে প্রায় ১৫ দিন ধরে পানির তীব্র সংকট।

তারা বলছেন, কোনো কোনো দিন রাতে কিছুটা পানি আসে, আবার কোনো দিন তাও মেলে না। ফলে সাহরি ও ইফতারে তাদের অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। পানি কেনার সাধ্যও অনেকের নেই। তাছাড়া গ্যাস সংকট তো রয়েছেই। রমজানে প্রতিটি মুসলিম পরিবারে রান্নাবান্নার বিশেষ আয়োজন থাকে। পরিবর্তন আসে খাবারে মেন্যু ও সময়ে। বছরের অন্য সময় যাই হোক, রোজায় ইফতার ও সাহরি খেতে হয় নির্ধারিত সময় অনুযায়ী। এমন পরিস্থিতিতে আবাসিকের গ্রাহকদের বাধ্য হয়ে রান্নার গ্যাসের জন্য বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। বাসায় গ্যাসের লাইন থাকার পরও এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন অনেকে। অন্যদিকে গ্যাসের এ সংকট শিগগিরই কাটছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কয়েকজন বাসিন্দা জানান, পানির অভাবে মনে হয় যেন তারা মরুভূমিতে বাস করছেন। ওয়াসার গাড়ি থেকে কিছুটা পানি কেনা যায়, কিন্তু সেটিও সঠিক সময়ে পাওয়া যায় না। সামর্থ্যবানরা প্রতিদিন পানি কিনে খান। পানির কারণে এ এলাকায় প্রায়ই মালিক-ভাড়াটিয়া ঝগড়া বা কথা কাটাকাটির খবর পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াসার মডস জোন-১০ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শফিক আহমেদ খান ওই এলাকায় পানির কোনো সমস্যা নেই জানিয়ে ফোন লাইন কেটে দেন।

অন্যদিকে এ বিষয়ে জানতে ১৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হুমায়ুন রশিদ জনির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, শীতকাল চলে যাওয়ার পর আবাসিকে গ্যাস সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও সময়মতো রান্নার জন্য তা যথেষ্ট নয়। ঠিকমতো গ্যাস না পেলেও গ্রাহককে প্রতি মাসে নির্ধারিত বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। গ্যাস না পাওয়ায় বিকল্প হিসেবে এলপিজি বা ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করায় গ্রাহকের রান্নার খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে।

দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে এটি বাড়তি মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষের জন্য। মান্ডা এলাকার একজন গৃহিণী বলেন, বিকাল ৫টা বাজে, ঘণ্টাখানেক পর ইফতার। এখনো চুলায় গ্যাস আসেনি। সারা দিন তো গ্যাস থাকেই না, ইফতারের সময়ও গ্যাস পাচ্ছি না।

রশিদ নামে একজন বলেন, রোজার মাসে অন্তত গ্যাসটা দেন। না পারলে মাসে যে এক হাজার ৮০ টাকা বিল নেন, সেটা মওকুফ করেন। তাও যদি না পারেন তাহলে ইলেকট্রিক চুলা কিনে দেন এবং মাসে মাসে তার বিলটা দিয়ে দেন।

গ্যাস সংকটের কথা স্বীকার করেছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘যেসব বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংযোগ আছে, যেহেতু আমাদের একটি মাত্র এফএসআরইউ কাজ করছে, ৩০ মার্চের আগে আরেকটি এফএসআরইউ আসবে না। সুতরাং আমাদের যে আমদানি করা গ্যাস ছিল, ২০ শতাংশ আমরা আমদানি করতাম, তার মধ্যে ১০ শতাংশ কমে গেছে। আমাদের নিজেদের যে গ্যাস ছিল তা থেকেও আমাদের উত্তোলন কমে গেছে। এগুলো বিবেচনায় এনে বাসাবাড়ির গ্যাসের ব্যাপারে আমাদের বিকল্প একটি সমাধান তো আছেই, এলপিজি। সবাইকে অনুরোধ করব, যেসব এলাকায় গ্যাসের স্বল্পতা দেখা যাচ্ছে তারা যেন এলপিজি ব্যবহারের দিকে নজর দেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব গ্যাসের উৎপাদনও কিছুটা কমেছে। সব মিলিয়ে আমরা আশা করছি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারব। তবে রমজানে কিছু সময় বিদ্যুৎবিভ্রাট হতে পারে।’

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রতিদিন ৩৪ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে ৩৫০ থেকে ৩৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় যা মোটেও সন্তোষজনক নয়। ফলে রমজানেও আবাসিকে গ্যাস সংকট থেকে যাচ্ছে।

আবাসিকে গ্যাস সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী কামরুজ্জামান বলেন, গ্রাহকের অভিযোগ আছে, অভিযোগ থাকবেই। যারা প্রথম দিকে লাইন নিয়েছেন তারা ঠিকমতো গ্যাস পাবেন, আর যারা শেষ দিকে লাইন নিয়েছেন তারা ঠিকভাবে পাবেন না। ওই লাইনে অতিরিক্ত গ্রাহক হলে তো তারা গ্যাস পাবেন না।

এদিকে বিদ্যমান এক চুলা ৯৯০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩৭৯.৭০ টাকা, দুই চুলা ১০৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫৯১.৯২ টাকা করতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে আবেদন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর ডিসেম্বরে একটি মূল্যায়ন কমিটি গঠন করে বিইআরসি। পাশাপাশি বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম বাড়াতে নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল বলে জানা গেছে। তখন বিইআরসি জানায়, মূল্যায়ন কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস অনুসন্ধান না করে আমদানিনির্ভরতার কারণে গ্যাস সংকটে পড়তে হচ্ছে। এ বিষয়ে ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, আমরা বারবার বলে আসছি আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিতে। কিন্তু সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে না। তারা আমদানির দিকেই বেশি ঝুঁকছে। ফলে এ ধরনের সংকট হবে, এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া গ্যাস চুরি এবং অবৈধ সংযোগের কারণে সংকট আরও বাড়ছে। যতদিন এ সমস্যাগুলো সমাধান না হবে ততদিন সংকট থাকবেই। ঢাকা ১৯৯০ সালে সিটি করপোরেশনের মর্যাদা লাভ করে। ১৯৯৪ সালে মোহাম্মদ হানিফ ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র হন। পরবর্তীতে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে ২০১১ সালে মেগাসিটি ঢাকাকে দুটি আলাদা সিটি করপোরেশনে ভাগ করা হয়। প্রশ্ন উঠেছে, নাগরিক সুবিধা কতটা নিশ্চিত হলো? সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবাসের পরও ঢাকার কয়েক লাখ বাসিন্দা মাটির চুলা ব্যবহার করছেন। এ মাটির চুলা ঐতিহ্যের টানে নয়, বরং বাধ্য হয়েই ব্যবহার করছেন তারা। অথচ তারা ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার বাসিন্দা। সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই কার্যক্রম শুরু করেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল)। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিটি করপোরেশন এলাকায় সেবার মান ও ব্যাপ্তি বাড়াতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিতাসের এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, বর্তমানে মোট ২৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫৩ জন আবাসিক গ্রাহককে সেবা দিচ্ছেন তারা। একই সঙ্গে ১২ হাজার ৭৮ বাণিজ্যিক গ্রাহককেও সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে আছেন, কিন্তু তিতাসের সেবা পাচ্ছেন না, এমন গ্রাহকের কোনো পরিসংখ্যান নেই প্রতিষ্ঠানটির কাছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের পশ্চিমে ছয়টি এলাকা— সাত মসজিদ হাউজিং, চাঁদ উদ্যান, নবীনগর, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান ও তুরাগ হাউজিং। এসব এলাকার অনেকাংশেই বৈধ কোনো গ্যাস সংযোগ নেই। এখানকার কয়েক লাখ বাসিন্দার রান্নার মাধ্যম এলপিজি বা গ্যাস সিলিন্ডার।

সাত মসজিদ হাউজিং এলাকার বাসিন্দা পারভিন আক্তার বলেন, ‘পুরো এলাকায় গ্যাস নাই। কয়েক বছর আগে ছিল, অবৈধ লাইন। পরে কেটে দিছে। এখন আমরা রান্নার জন্য সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করি। কিন্তু এ এলাকার তুলনামূলক কম আয়ের মানুষরা রান্না করেন মাটির চুলায়।’

নবীনগর হাউজিং এলাকার বাসিন্দা মিরাজ হোসেন বলেন, ‘আমরা লাকড়িতে রান্না করি। এক মণ কাঠ কিনি ৪০০ টাকায়। গ্যাসের লাইন থাকলে আমাগো জন্য অনেক সুবিধা হইত।’ মোহাম্মদপুরের মতো একই অবস্থা দেখা গেছে গাবতলীর হাড্ডিপট্টি, সুইপার কলোনি এলাকায়। ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দা হয়েও গ্যাস না পাওয়ার আক্ষেপ আছে বসিলা উত্তরমুড়া, দক্ষিণমুড়া, দয়াল হাউজিং, ওয়েস্ট ধানমন্ডি, বউ বাজার এলাকার বাসিন্দাদের।

তবে এসব এলাকার জন্য আপাতত কিছুই করার নেই বলে জানিয়েছে গ্যাস সরবরাহ প্রতিষ্ঠান তিতাস। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বলেন, গ্যাস সংযোগের সিদ্ধান্ত সরকারের। আমরাও সেভাবেই কাজ করি। নতুন কোনো এলাকায় আপাতত গ্যাস সংযোগ দেওয়ার সুযোগ নেই। এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। আবাসিকের পাশাপাশি বাণিজ্যিক পর্যায়েও একই সিদ্ধান্ত। শুধু ইকোনমিক জোনের ক্ষেত্রে বিকল্প ভাবার সুযোগ আছে।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ