ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

স্ত্রীর বর্ণনায় কেমন আছেন নাবিক নুর উদ্দিনসহ অন্যরা?

প্রকাশনার সময়: ১৩ মার্চ ২০২৪, ২০:২৩ | আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৪, ২১:০২

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ’র নাবিকদের ফেরত পেতে আর্তনাদ করছেন পরিবারের স্বজনেরা।

বুধবার (১৩ মার্চ) সকালে চট্টগ্রাম নগরীর বারেক বিল্ডিংয়ে কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে তাদের ভিড় করতে দেখা যায়।

এ সময় স্বামীকে ফেরত পেতে আর্তনাদ করেন এমভি আবদুল্লাহ’র নাবিক নুর উদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস।

‘মুক্তিপণ না দিলে ওদের সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলবে’ উল্লেখ করে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘আমাকে গতকাল (মঙ্গলবার) বিকেলে কল দিয়ে আমার স্বামী বলেন তাদের জাহাজে জলদস্যু আক্রমণ করেছে। আমার স্বামী আমাকে জানান, তাদের অবস্থা অনেক খারাপ। তাদের অফিসে কল দিয়ে বিষয়টি জানাতে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাদের অফিসে কল দিয়ে জানাই। তিনি আমাকে সন্ধ্যা ৬টা ৪৯ মিনিটে শেষবার ভিডিও কল দেন। এরপর একটি অডিও রেকর্ডে তিনি আমাকে জানান, ওদেরকে অন্য একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুক্তিপণ না দিলে ওদেরকে একজন করে করে গুলি করে মেরে ফেলবে। আমার সরকারের কাছে একটিই আবেদন আমার স্বামীকে যেভাবে হোক এনে দেন। টাকা পয়সা দরকার নেই, আমি আমার স্বামীকে চাই।’

এদিকে স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসকে পাঠানো ওই অডিও বার্তায় নুর উদ্দিন বলেন, ‘এ মেসেজটা সবাইকে পৌঁছে দিও। আমাদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে। ফাইনাল কথা হচ্ছে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলেছে। তাদের যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলেছে। এখন সব মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে।’

হেড অফিসে পাঠানো অন্য একটি অডিও রেকর্ডে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ’র চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান বলেছেন, ‘স্যার, আমাদের সব মোবাইল কেড়ে নিয়েছে। এটাই শেষ সুযোগ। আমাদের জাহাজের যে ইন্টারনেট সার্ভিস আছে সেটার সার্ভার যদি খুলে দেওয়া যায়, তাহলে আমরা গোপনে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করব, যেকোনো মুহূর্তে। খুলে দিলে আমরা সুযোগমতো যোগাযোগ করতে পারব।’

নাবিক আইনুল হক অভির মা লুৎফে আরা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে আমাকে বিকেলে কল দিয়ে বলেম, “আম্মু ডাকাত আসছে”। ও এতটা উত্তেজিত ছিল যে আমি তার কথা বুঝছিলাম না। বারবার আমি তাকে বলি কি বলছে সেটা আমি বুঝছি না। কিছুক্ষণ পর আবার কল দিয়ে বলে, ‘আম্মু ডাকাত উঠে গেছে, আমাদের জন্য দোয়া করো। আমাদের আর কিছু করার নেই।” কিছুক্ষণ পর আবার কল দিয়ে বলে তাদের কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সে তখন কান্নাকাটি করছে। খুব বেশি কান্না করছিল। আমিও অনেক কান্না করছিলাম তখন। এরপর সে আমাকে বলে, যারা এখানে উঠেছে তারা সবাই মুসলিম।’

নাবিক শরিফুল ইসলামের ভাই দিদারুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ভাইয়ের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে গতকাল ইফতারের পরে। সে শুধু বলেছে এরপরে আর যোগাযোগ হবে না। তখনও আমরা জানতাম না তাদের জাহাজ ডাকাতদের কবলে পড়েছে। পরে অনলাইনে দেখে আমরা সেটা জানতে পারি। ওর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। প্রথম সন্তান আসবে তাদের ঘরে। তাই হয়তো সে বলতে চায়নি। আমরা ছয় ভাইয়ের মধ্যে ও পাঁচ নম্বর। পরিবারের সবাই খুব চিন্তিত। আমার বাবা, মা ও তার স্ত্রী গতকাল থেকেই কান্না করছে।’

জাহাজের ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদের মা জ্যোৎস্না বেগম বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) রাত আটটায় আমার সঙ্গে তানভীরের শেষ কথা হয়েছে। তখনও তাদের কোনো খাবার বা ইফতার দেওয়া হয়নি। আমার ছেলে বলেছে, তাদেরকে অন্য এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কীভাবে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা যায় সে ব্যাপারে তাদের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছে। তাদের গায়ে এখন পর্যন্ত কোনো হাত তুলেনি বলেও জানায় আমার ছেলে। তাদের জাহাজে নাকি পানি নেই। সেটা দেবে কি না, জানে না তারা।’

জানা গেছে, এমভি আবদুল্লাহ নামে জাহাজটি চট্টগ্রামের কেএসআরএম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বেলা ১২টার দিকে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজটি সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। ওই জাহাজের ২৩ নাবিককে জিম্মি করা হয়। জাহাজটি মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাচ্ছিল।

নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সোমালিয়া উপকূল থেকে প্রায় ৫০০ নটিক্যাল মাইল দূর দিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিল। কিন্তু দুপুর একটার দিকে ভারত মহাসাগরের গভীরে গিয়ে শতাধিক জলদস্যু একে-৪৭ রাইফেলসহ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।

জাহাজে থাকা নাবিকেরা হলেন- জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মো. শামসুদ্দিন, মো . আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুর উদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।

জাহাজের নাবিকদের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে কেএসআরএম গ্রুপের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘রাত তিনটায় নাবিকদের সঙ্গে আমাদের শেষ যোগাযোগ হয়েছে। তারা সবাই নিরাপদ ও সুস্থ আছেন। জাহাজটিকে সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জলদস্যুদের সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ হয়নি। তারা এখনও কোনো দাবি বা মুক্তিপণ চায়নি। তারা আগে জাহাজটি তাদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে তারপর হয়তো মুক্তিপণ চেয়ে যোগাযোগ করতে পারে। আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে নাবিকদের অক্ষত উদ্ধার করা। এরপর জাহাজটি অক্ষত উদ্ধার করা।’

তিনি আরও বলেন, ‘অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। এর আগেও জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়া আমাদের একটি জাহাজ ১০০ দিনের মধ্যে আমরা ২৬ জন নাবিকসহ অক্ষত উদ্ধার করেছি। ওই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা এবারও অক্ষত অবস্থায় নাবিকদের উদ্ধার করতে পারব।’

এর আগে, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল একই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি বাংলাদেশি জাহাজ ‘জাহান মণি।’

নিকেলভর্তি ওই জাহাজের ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে জিম্মি করা হয়। সরকারি উদ্যোগসহ নানা প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ মার্চ তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ